পশ্চিমবঙ্গের বাঙালী মুসলমানদের নিয়ে কিছু লিখতে বা বলতে বসলেই, আমি বেশ অনুশোচনায় ভুগি। জীবনের দীর্ঘ সময় বিপ্লব টিপ্লব নিয়ে কত কথা বলে গেছি। কফি হাউসে বসে কাফকা, ক্যামু থেকে গঁদার, ত্রুফো, লেনিন, তোগলিয়ত্তি কম আওড়াইনি, অথচ ঘরের আশপাশের যে বিপুল সংখ্যক মুসলমান, আমার পড়শী, তাদের সম্পর্কে সামান্য জ্ঞানটুকুও ছিল না এই সেদিন অবধি।
মাত্র কয়েক বছর আগে, ২০১০ সালে বোধহয় সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচারের এক রিপোর্ট বের হবার পরে পরে, জানা গেল রাজ্যের বাঙালি মুসলমানের জীবনযাত্রার মান, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের তুলনায়, চোখে পড়ার মতো বেশ খারাপ। মুসলিম ছাড়া আদিবাসী ও তপশিলী সম্প্রদায়ের অবস্থাও খারাপ। কিন্তু মুসলিম জনগোষ্ঠী যেহেতু বড় সংখ্যক, ফলে তাদের পরিস্থিতি নিয়ে হুলস্থুল পড়ে গেল চারদিকে। বামেরা তখনও ক্ষমতায়। মমতা ব্যানার্জী সে সময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি লুফে নিলেন সাচার রিপোর্ট। এমনিতেই জমি অধিগ্রহণ নিয়ে কৃষকেরা ধীরে ধীরে বামেদের ওপর খর্গহস্ত, বলাবাহুল্য তাদের অধিকাংশই আবার মুসলমান। আগুনে ঘি পড়ল সাচার রিপোর্ট জুড়ে মুসলিম বঞ্চনার ঘটনা সামনে আসায়।
এই সব চাপানো উতরের মধ্যেই ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটে গেল। মমতা বন্দোপধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হলেন। ধরে নেওয়া হলো মুসলিম জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন নিয়ে যাবতীয় বাধা দুর হতে আর বেশি সময় লাগবে না।
ঘটনাচক্রে বামেদের বিদায় ও মমতা ব্যানার্জির কুর্সি আহরনের মধ্যবর্তী সময়ে বাঙালী জাতির যাপন নিয়ে আমি এক দীর্ঘ ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানিয়ে ফেল্লাম–মুসলমানের কথা।
এ ছবি নির্মানের পেছনে ছিলেন এক ও অদ্বিতীয় রাজেন্দ্র সাচার। দিল্লিতে এক সেমিনারে সাচার সাহেবের সঙ্গে ভাল রকম বন্ধুত্ব হবার কয়েক দিন বাদে সাচার সাহেব প্রায় ফতোয়া দিয়ে জানিয়ে দিলেন যে দিল্লি হিল্লি না ঘুরে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে গিয়ে পড়শি জীবন নিয়ে বিস্তারিত খোঁজ নাও।
সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। বাঙালি মুসলমান সমাজের ওপর ভালো কোন বই পাচ্ছিনা। দু একজনের সঙ্গে একটু আধটু কথা বলে ভাসা ভাসা কিছু ধারনা তৈরী হচ্ছে মাত্র। কিন্তু ওই সামান্য ধারনা নিয়ে তো আর আস্ত একটা ডকুমেন্টারি ফিল্ম করা যায় না। তখন ঠিক করলাম, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় গিয়ে সাধারণ লোকজনকে জিজ্ঞেস করব যে, তাদের অবস্থা কিরকম এবং কোন রকম সামাজিক বৈষম্য তাদের প্রতি হয় নাকি! পাশাপাশি কয়েকজন স্কুল, কলেজ শিক্ষক, উকিল ইত্যাদি পেশাদারকেও ইন্টারভিউ করলাম। পুলিশ অফিসার নজরুল ইসলাম দিলেন বড় সাক্ষাৎকার। বস্তুত ছবির স্টাইলটা হলো এক প্ল্যাটফর্ম, যেখানে সমাজের সাধারণ মুসলিম জনতা খোলাখুলি নিজেদের কথা জানাবেন। মুসলমানের কথা আক্ষরিক অর্থেই মুসলমানের কথকতা। আমি সেখানে ছাত্র। কোন মাতব্বর, তালেব সিনেমা নির্মাতা না।
ছবিটির প্রথম স্ক্রিনিং হলো কলকাতা প্রেস ক্লাবে। সেও এক অসামান্য অভিজ্ঞতা। দলে দলে কোথা থেকে খবর পেয়ে গ্রাম মফস্বল উজার করে মানুষ আসছে। অধিকাংশই মুসলিম। তখনও বিষয়টি হিন্দু মুসলিম বলে দেখিনি। শুধু একটা জিনিস মনে হচ্ছিল এইরকম গ্রামের গন্ধ লাগা ভিড় আমি কখনও দেখিনি। ছবি শেষ হতে এক অদ্ভুত নীরবতা। সামান্য সময়ের জন্য অবশ্য। কিছু পরে ভিড় দুভাগে আমার দিকে এগোতে লাগলো। একদল কলকাতার বামপন্থী ইন্টেলেকচুয়াল মাথা ঝাঁকিয়ে জানিয়ে দিলেন, কিস্যু হয়নি এছবি। এতো ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি।
অপর দল, অধিকাংশের চেহারা ম্লান, টুপি মাথায়, পাজামা, পাঞ্জাবী গায়ে। ধীরে ধীরে এলেন। হাত মেলালেন আমার সঙ্গে। মুখে অদ্ভুত প্রশান্তি। এই প্রথম আমার পশ্চিমবঙ্গের আটাশ শতাংশ বাঙালী মুসলমানদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠার মুহুর্ত।
অনুশোচনা যদি নাও বলি, আফশোস তো বটেই। এত বছর পাশাপাশি থেকেও বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাইনি বলে। আসলে আমি একা নই। মধ্যবিত্ত এলিট প্রগতিশীলদের দস্তুর এটাই, বাঙালী মুসলমানদের সম্পর্কে কিছুমাত্র আগ্রহী না হয়ে বরং তাদের প্রতি অধিকাংশ সময় বিষোদগার করে যাওয়া।
চোদ্দ পনেরো বছরে একটা সম্প্রদায়কে চেনার চেষ্টা করা যায়। চেনা যায় না। আমি কখনো দাবীও করিনি যে বাঙালী মুসলমানদের সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ। এ লেখা আদৌ কোন জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ, তাও নয়।
বলতে পারেন এ একরকম বাইরের ঘরে বসে অন্দরমহলের দিকে তাকিয়ে থাকা। এই কয়েকবছর ধরে আমি গ্রামের পর গ্রামে গেছি। মুসলিম অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদ, মালদা, দুই চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলী, বর্ধমান সব জায়গায় গেছি সুযোগ পেলেই। সুতরাং বলতে পারেন এ লেখা মূলত একধরনের পর্যবেক্ষণ। মুসলিম সম্প্রদায়ের একজন না হলেও তাদের হিতাকাঙ্ক্ষী হয়ে বোঝার চেষ্টা করছি তাদের যাপন চিত্র।
ছবি করার সময়েই দুটো বিষয় বুঝেছিলাম। এক, ১৯৪৭ সালের বাংলা ভাগ এপারের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিয়ে গেছে। ৪৭-৫০ অবধি ভদ্রলোক মুসলমানদের নব্বই শতাংশ ওপারে চলে যান বা যেতে বাধ্য হন। মধ্যবিত্ত শ্রেণী অবলুপ্ত হবার পর এপারে থেকে যান গরীবস্য গরীব মুসলমানেরা। ক্ষুদ্র চাষী, ক্ষেতমজুর, দর্জি, কসাই, জেলে এরকম আরও নানা পেশার লোকজন। অধিকাংশ নিরক্ষর। বেঁচে থাকাই যেখানে কষ্টকর, সেখানে পড়াশোনা করার প্রশ্ন ওঠে না। সৈয়দ বদরুদ্দোজা বা কাজেম আলী মির্জা বা হাসানুজ্জামান, জাহাঙ্গীর কবিরের মতো দু একজন বিত্ত ও প্রভাবশালী ছিলেন বটে, তবে তারা, নিজেরাও তখন কংগ্রেসের মধ্যে কিভাবে জায়গা করে নেবেন, সেই চিন্তায় বিভোর। কমিউনিটি কি করবে তা নিয়ে ভাবার সময় তখন তাদের ছিল না। মুসলিম লীগের মৃত্যু ঘটে গেছে। বহুদিন শুধু একা হাসানুজ্জামান দলের বাতি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু একজনের ব্যক্তি দক্ষতা দিয়ে সমগ্রকে বিচার করা যায় না। ৪৭-৫০ সাল অবধি জেলায় জেলায় চোরাগোপ্তা ও খোলাখুলি দাঙ্গা মুসলিম জনজীবনকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল। নদিয়া জেলা থেকে একমাসে, শোনা যায় বিপুল সংখ্যক মুসলমানকে ওপারে চলে যেতে বাধ্য করা হয়। খোদ কলকাতার জন বিন্যাস পাল্টে যেতে লাগলো ওই সময় সময়। অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি সর্ব ক্ষেত্রেই ৪৭-৫০ তো বটেই, ষাট সত্তরের দশক অবধি মুসলিম জীবন প্রবল সঙ্কটে। দাঙ্গা তো আছেই, তার ওপর পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ লাগলেই, নীরিহ বাঙালি মুসলমানের দুর্ভোগের শেষ নেই। চর সন্দেহে থানা, পুলিশ, জেল জরিমানা, পাড়াপড়শির টিটকারি কিছুই বাদ যেত না মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া মানুষজনের।
একটা কথা বলতে হবে যে, বর্ধিষ্ণু মুসলমানদের অনেকেই যেমন মূলত নিরাপত্তার কারণে কংগ্রেস করছেন। ঠিক তেমনি গ্রামের গরীব কৃষক বা কলকারখানার মজদুর কিন্তু ক্রমেই ঘনিষ্ঠ হচ্ছেন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে।
১৯৭৭ এ বামফ্রন্টের ক্ষমতা দখলের মূলে গ্রামীণ সর্বহারার বিরাট ভূমিকা ছিল। যাদের অধিকাংশই মুসলমান। ততদিনে বাংলাদেশ হয়ে গেছে। ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের দোহাই দিয়ে মুসলিম হেনস্থা কমেছে। ১৯৭২ এ কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় বাঙালি মুসলমানের জন্য কিছুটা স্পেস দিয়ে ক্যাবিনেটে বাঙালী মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী করলেন। বামেরা ক্ষমতায় আসার পর বর্গাদারী সিস্টেম ও জমিহারাদের জমি বিতরণের মধ্যে দিয়ে মুসলিম সমাজের গরীব অংশকে নিজেদের দিকে নিয়ে এলেও আশ্চর্যজনকভাবে দলের বা সরকারের নীতি নির্ধারনে মুসলিম ভূমিকা কার্যত হ্রাস পেতে লাগলো। নব্বই দশকের বাম রাজনীতিতে সামনের সারিতে মুসলিম মুখ প্রায় অদৃশ্য।
আসলে ততদিনে বাম পার্টিগুলোয় ঘামে ভেজা, লড়াকু কর্মী, সমর্থকদের পরিবর্তে দ্রুত উঠে আসছে হোয়াইট কালার শ্রমিক, স্কুল, কলেজ মাষ্টার, বা একদা সামন্ত পরিবারের সন্তানেরা।
নব্বইয়ের পরবর্তী সময়ে অন্যান্য সব সংসদীয় দলের মতো বামেরাও মোটামুটি নয়া অর্থনীতি, বিশ্বায়নের মোহে পাল্লা দিতে লাগলো অন্য সব রাজ্যের তথাকথিত উন্নয়ন মডেলের সঙ্গে। পরিস্থিতি এমন এক জায়গায় পৌঁছে গেল, তখন শুধুমাত্র টাটা বিড়লা লাল সেলাম বলা বাকি। পেছনে হঠতে লাগলো বামপন্থী রাজনীতির পুরনো শ্রেণী মিত্ররা। গরীব কৃষক, ছোট পুজিঁর ব্যবসায়ী, অসংগঠিত শ্রমিক। পুজিঁ বনাম আমজনতার দ্বন্দ্ব যত বাড়তে লাগল তত পরিস্কার হতে লাগল বামপন্থীদের পক্ষপাত কোনদিকে। মুজাফফর আহমেদ, আব্দুল হালিম, আবদুল্লাহ রসুল, মহম্মদ আমিনের দল ক্রমেই বাবু ভদ্দরলোকদের পার্টি হয়ে গেল। ভাবতে খারাপ লাগে মুসলিম অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদের গ্রামে মুসলমান পরিবারের পাকা বাড়ি কটা ছিল তা হাতে গুণে বলা যেত। মুসলিম পাড়া ও বর্ণ হিন্দু পাড়াগুলো দেখলে সাদা চোখেই বৈষম্য স্পষ্ট হয়ে যেত। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন আলটপকা বলে বসলেন যে সীমান্ত এলাকায় অধিকাংশ মাদ্রাসা সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটি।
আসলে এধরনের কথা তখনই লোকে বলে যখন মাটির সঙ্গে কিছুমাত্র যোগ থাকে না। আসলে শুধু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নন, সামগ্রিক ভাবে আমাদের উচ্চ বর্গের লোকজন জানেনই না যে, সীমান্ত এলাকায় মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাতে স্কুল খুবই কম। ফলে মাদ্রাসা ছাড়া ওখানে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া কঠিন। বাম আমলে পঁচিশ শতাংশ বাঙ্গালী মুসলমানের মধ্যে সরকারি চাকরি করতেন মোটে দুই শতাংশ। সাংবাদিক খুব বেশি হলে দশজন।
অধ্যাপক হাতে গুণে বলা যেত। অভিনেতা প্রায় নেই। কলকাতার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে মুসলিম দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হয়। রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে মুসলিম মুখ শুন্যে। আসলে আমাদের উচ্চ বর্গীয় সামাজিক কাঠোমাটাই এমন যে সেখানে নীচতলা থেকে সমাজের এলিট বর্গে উঠে আসা কঠিনতম। বামেরাও জাত ভিত্তিক কাঠামো ভাঙ্গা দুরের কথা, নিজেরাও টের পাননি কখন কিভাবে যেন বামুনবাদী কাঠামোতে সেঁধিয়ে গেছে।
এটা আশ্চর্যজনক নয়, সমাজের বড় সংখ্যক মুসলমানকে বাদ দিয়ে আমাদের তথাকথিত প্রগতিশীল সমাজ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে! অথচ মুখে সবসময় বলে যাব, মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম, হিন্দু মুসলমান…..।
পশ্চিমবঙ্গের বাঙালী মুসলমান, কেউ মানুক না মানুক, নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। আমরা অধিকাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক বাইরে যত উদার, অসাম্প্রদায়িক, আসলে একেবারেই তা নয়। মমতা ব্যানার্জী ক্ষমতায় আসার পর সংখ্যালঘু উন্নয়ন নিয়ে ঢাক বেজেছে বেশি। কাজের কাজ খুব কিছু হয়নি। হ্যাঁ, কবরখানা রঙ হয়েছে। কিছু মস্তান টাইপের লোককে মুসলিম মসিহ বানিয়ে দলের কয়েকটি পদে এনেছেন এটি সত্যিই। মমতা নিজেও মাথায় হিজাব ঢেকে নামাজ করেছেন। ইমামদের ভাতা দিয়েছেন। আসলে দুটো কারণে তিনি এই মুসলিম বন্ধু সেজেছেন। এক, মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ককে তৃণমূল কংগ্রেসের একচেটিয়া করা, দুই, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের সুযোগে হিন্দু ভোট সংহত হয়ে বিজেপির দিকে যাবে। বামেদের পরিসর কমতে থাকবে। একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। মমতার রাজত্বকালে চরম মুসলিম বিদ্বেষী আরএসএসের রমরমা বিপুল পরিমাণ বেড়েছে। সেক্ষেত্রেও অ্যাডভান্টেজ মমতা বন্দোপাধ্যায়। আরএসএসের জুজু দেখিয়ে মুসলিম ভোটকে এককাট্টা রাখা। মুসলিম মহল্লায় আজ কান পাতুন। শুনবেন মমতার মুসলিম প্রীতি আদতেই পলেটিক্স অফ টোকেনেজিম। একজন আরাবুল বা একজন ববি হাকিম ক্ষমতা পেলে সামগ্রিক চেহারার বদল ঘটেনা।
তারমানে মুসলিম জনগোষ্ঠী একদিকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, অন্যদিকে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের বোড়ে। আর একটা ভুল ধারনা সংখ্যাগুরু মননে, মূলত মিডিয়ার সৌজন্যে পাকাপাকিভাবে রয়ে গেছে বহু বছর ধরে। যেটা আমার ছবি করার পরে পরেই মিথ মনে হয়েছে। তা হলো মুসলিম জনগোষ্ঠী নিতান্তই কৌম সমাজের বাসিন্দে।
ঈদের পরের দিন বা ভোট দিতে যাবার একটি ছবিই বছরের পর বছর আমরা দেখি। বোরখা পরে মুসলিম মহিলা। সিনেমায় মুসলিম চরিত্র হলেই তার দাঁড়ি থাকবে এবং সে হেঁ হেঁ করবে। ধরে নেওয়া হয় মসজিদের ইমাম ছাড়া সাধারণ মুসলমান কোন সিদ্ধান্ত নেয় না। একমাত্রিক মুসলিম ভাবাটা যে কত ভুল তা একটু খোঁজ খবর করলেই জানতে পারেন। আতরফ, আশরফ বা সিয়া সুন্নি এসব বাদ দিলেও এক মুসলমান সমাজে যে কত ভাগ তা কেউ জানতেও চান না। জামাত শব্দটি প্রগতিশীল কলকাতায় প্রায় নিষিদ্ধ। এডস রুগীর মতো ভয়াবহ। অথচ খুব কম জন জামাতের মধ্যেও যে কত বিভাজন তা বুঝতে চান না। আগেই বলেছি, অন্তত কয়েকবছর ধরে জেলায় জেলায় ঘুরে নিশ্চিত হয়েছি যে কোনভাবেই আজকের দিনে মুসলিম সমাজে ইমাম সর্বশক্তিমান নন। তাদের কাজ মূলত সামাজিক নানা অনুষ্ঠান পরিচালনা করা। রাজনৈতিক দিক নির্দেশনা দেবার যোগ্যতা বা দক্ষতা খুব একটা তাদের আছে বলে মনে হয় না।
মুসলিম ভাতৃত্ব বলে অনেক কিছু চালাবার চেষ্টা হয় বটে, তবে তা ওই শুনতে ভালো লাগে। বাস্তবে খুব একটা আছে বলে মনে হয় না। ওহাবি বনাম পীর, হানাফি কিম্বা আহলে হাদীস এই রকম ভাগাভাগি তো সমাজে আছেই। আরও আছে মুসলিম সমাজের শ্রেণী বৈষম্য। বাঙালী মুসলমানদের আইডেনটিটির বহুমুখী সঙ্কটের অন্যতম অবাঙ্গালী, উর্দু ভাষী মুসলমানদের কাছেও বাঙালী মুসলমানের ‘কৌলীন্য’ নেই। পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম জনগোষ্ঠীর খুব কম শতাংশ উর্দু ভাষী। কিন্তু রাজনৈতিক, সামাজিক ক্ষমতার কেন্দ্রে, যেটুকু যা মাতব্বরি, সবটুকু তারাই ভোগ করেন। আসলে হিন্দু জনগোষ্ঠীর কাছে উর্দু ও মুসলমান আজও প্রায় সমার্থক। এমনকি অবাঙ্গালী মুসলমানদের কাছেও। দিল্লি, কেরল, মহারাষ্ট্র ও অন্যান্য বড় শহরে আরবি জানা মুসলমানেরা বাঙালী মুসলমানদের ধর্মীয় স্বীকৃতি দিতে চান না। আগে বাঙালী না আগে মুসলমান এই দ্বন্দ্ব কিন্তু বহুদিনের। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের আরও এক বৈশিষ্ট্য আছে। ভারতের সব শহরে আপনি মুসলিম মহল্লা পাবেন। অর্থনীতি, রাজনীতিতে অল্প হলেও তাদের কিছু অবদান বা কন্ট্রিবিউশন আছে। এরাজ্যে বাঙালী মুসলমানদের পাবেন শুধু গ্রামে। শহরে তাদের স্থায়ী ঠিকানা নেই বল্লেই চলে। এও নিশ্চিত বঙ্গ ভঙ্গের পরিণাম।
গত কয়েক বছরে বাঙালী মুসলমানদের মধ্যেও বিপুল পরিবর্তন এসেছে। অধ্যাপক, ডাক্তার, এঞ্জিনিয়ার, প্রযুক্তিবিদ উঠে আসছে একদার পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে থেকে। যা কয়েকবছর আগে ছিল না, আজ পশ্চিমবঙ্গেও মুসলিম মিডল ক্লাস দৃশ্যমান হয়েছে। এখন অন্তত একশো, দেড়শো অধ্যাপক পাবেন। কোটিপতি ব্যবসায়ীও এখন বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে পাওয়া আজ কঠিন নয়। গরীব মুসলমানদের বড় অংশ চাকরি পাবেন না মেনে নিয়ে দুবাই যাচ্ছেন, ভারতের সব রাজ্যে তো যাচ্ছেনই। আসলে কয়েক বছরে মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে। এর পিছনে আল আমিন ও অন্যান্য বেশ কয়েকটি বেসরকারি মিশনের অবদান বিরাট। সমস্যা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্ত ও ধনী বাঙালী মুসলমানদের মধ্যেও সাংস্কৃতিক চেতনার বড় অভাব। ওয়াজ মেহফিলে টাকা দেবার লোক অনেক। ঈদে উট কোরবানি দেবার টাকা খরচ করার বাঙালী মুসলমান পাবেন। কিন্তু নাটক, সিনেমা বাদ দিন, ভালো ম্যাগাজিন বের করার লোক পাবেন না। হতে পারে নতুন প্রজন্মের যারা সমাজে উঠে আসছেন, তাদের কয়েকপুরুষের শিকড় গ্রামের। ফলে তাদের অনেকের মন, মানসিকতায় গ্রাম্য সঙ্কীর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো থেকেই গেছে। কিন্তু সামনে এগোতে গেলে বাঙালী মুসলমানদের কুপমুন্ডকতা ঝেড়ে বের হতে হবে। নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে না নিলে সারা জীবন অনুকম্পা নিয়েই বাঁচতে হবে। স্বপ্ন দেখতে হবে বাঙালী মুসলমানদের। বড় হবার, সামনে এগোবার স্বপ্ন।
(সৌমিত্র দস্তিদার ডকুমেন্টারি নির্মাতা; গুজরাত গণহত্যা নিয়ে Nothing Official ও তৎপরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে Genocide and after– তাঁর দুটি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টারি; পশ্চিম বঙ্গের বাঙালী মুসলমানদের নিয়ে তৈরী করেছেন মুসলমানের কথা ডকুমেন্টারিটি)