অর্থনৈতিক উন্নয়নের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো যুদ্ধ। বৈশ্বিক সংঘাত আরো বৃদ্ধি পেলে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতির আশা, এমনকি বেঁচে থাকাটাও পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারে। পরমাণু বিজ্ঞানীদের বুলেটিন সম্প্রতি বিশ্বধ্বংসের ঘড়ি (Doomsday Clock)-র কাঁটাকে ঘুরিয়ে মধ্যরাত থেকে মাত্র ৯০ সেকেন্ডে দূরে এনে রেখেছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জানিয়েছে যে, ২০২২ সালে বিশ্বে সর্বাধিক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ইউক্রেনের, এর অর্থনীতি ৩৫ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। ইউক্রেনের যুদ্ধ শীঘ্রই শেষ হতে পারে এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরু হতে পারে, তবে তা নির্ভর করছে ২০১৪ সালে শুরু হওয়া মার্কিন-রুশ প্রক্সি যুদ্ধের শিকার হিসাবে ইউক্রেন তার কত দুর্দশা হলো সেটা অনুধাবন করতে পারার উপর।
প্রক্সি যুদ্ধ শীঘ্রই শেষ না হলে, ইউক্রেন ভয়াবহ এক ভবিষ্যতের মুখোমুখি হবে। দীর্ঘমেয়াদী বিপর্যয় এড়াতে ইউক্রেনকে আফগানিস্তানের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। এটি ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাও গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, ইরাক, সিরিয়া এবং লিবিয়াতে মার্কিন প্রক্সি যুদ্ধের দিকেও তাকিয়ে দেখতে পারে।
আফগানিস্তানের সোভিয়েত-সমর্থিত সরকারকে হয়রানি করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭৯ সালে থেকে মুজাহিদিনদের (ইসলামী যোদ্ধা) সশস্ত্র করতে থাকে। প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেবিগনিউ ব্রেজেজিনস্কি পরে ব্যাখ্যা করেছিলেন, মার্কিন উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে সরাসরি হস্তক্ষেপে প্ররোচিত করা, যাতে এটি একটি ব্যয়বহুল যুদ্ধে আটকে যায়। এর দরুন আফগানিস্তানের যে ক্ষতি হবে তা মার্কিন নেতাদের উদ্বেগের বিষয় ছিল না।
সোভিয়েত সামরিক বাহিনী ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে প্রবেশ করে (যেমনটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আশা করেছিল), এবং গোটা ১৯৮০-র দশক জুড়ে তারা যুদ্ধ করে। এদিকে, মার্কিন-সমর্থিত যোদ্ধারা ১৯৮০-র দশকে আল-কায়দা এবং ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে তালেবান প্রতিষ্ঠা করে। ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আল-কায়দা এবং তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আফগানিস্তানে আক্রমণ চালায়। এই যুদ্ধ পরবর্তী ২০ বছর ধরে, ২০২১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে দেশ ছেড়ে চলে আসা পর্যন্ত, চলতে থাকে।
আফগানিস্তান আজ এক ধ্বংসস্তূপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক ব্যয়ের ২ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি অপচয় করেছে, আর আফগানিস্তান এখন হতদরিদ্র। ২০২১ সালে তার মাথাপিছু জিডিপি ছিল ৪০০ ডলারেরও কম।
ইউক্রেনে প্রক্সি যুদ্ধ শুরু হয়েছিল নয় বছর আগে, যখন মার্কিন সরকারের মদদে ইউক্রেনের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভিক্টর ইয়ানুকোভিচকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। মার্কিন দৃষ্টিকোণ থেকে ইয়ানুকোভিচের পাপ ছিল ইউক্রেন (এবং জর্জিয়া)-কে অন্তর্ভুক্ত করে ন্যাটোকে সম্প্রসারণের মার্কিন ইচ্ছার মুখেও ইউক্রেনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার প্রচেষ্টা। যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য ছিল কৃষ্ণ সাগর অঞ্চলে ন্যাটো দেশগুলিকে দিয়ে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০১৪ সাল থেকে ব্যাপকভাবে ইউক্রেনকে অস্ত্রসজ্জিত ও অর্থায়ন করছে।
কিন্তু ইউক্রেনের দুটি কঠোর রাজনৈতিক বাস্তবতাকে যুক্তরাষ্ট্র উপেক্ষা করেছিল। প্রথমটি হল পশ্চিম ইউক্রেনের রাশিয়া-বিদ্বেষী জাতীয়তাবাদী এবং পূর্ব ইউক্রেন এবং ক্রিমিয়ার জাতিগত রুশদের মধ্যে জাতিগত ও রাজনৈতিকভাবে গভীর বিভক্তি। দ্বিতীয়টি হল ইউক্রেনে ন্যাটো সম্প্রসারণ রাশিয়ার একটি রেডলাইন অতিক্রম করে; ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যুক্ত করা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ঠেকাতে রাশিয়া শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে এবং প্রয়োজনে লড়াইয়ের সম্প্রসারণ ঘটাবে।
২০২১ সালের শেষের দিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে তিনটি দাবি উত্থাপন করেন- ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে এবং ন্যাটোর বাইরে থাকতে হবে; ক্রিমিয়া রাশিয়ার অংশ থাকবে; এবং মিনস্ক ১ ও ২ চুক্তি অনুসারে দনবাস স্বশাসিত অঞ্চল হিসেবে থাকবে।
বাইডেন-সুলিভান-ন্যুল্যান্ড গোষ্ঠীটি ন্যাটো সম্প্রসারণের প্রশ্নে আলোচনা প্রত্যাখ্যান করে, আট বছর পূর্বে এরাই ইয়ানুকোভিচের উৎখাতে মদদ যুগিয়েছিল।
২০২২ সালের মার্চ মাসে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি মার্কিন-রুশ প্রক্সি যুদ্ধের শিকার হিসাবে তার দেশের ভয়াবহ অবস্থা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন যে, ইউক্রেন একটি নিরপেক্ষ দেশ হবে এবং তার নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিতে হবে। তিনি প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন যে, ক্রিমিয়া এবং দনবাসের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এই শান্তি প্রক্রিয়াকে আটকে দেয়।
কিসের ভিত্তিতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তা আজ স্পষ্ট। ইউক্রেন হবে একটি ন্যাটোবহির্ভূত নিরপেক্ষ দেশ। ক্রিমিয়া রাশিয়ার কৃষ্ণ সাগর নৌবহরের ঘাঁটি হিসেবে থাকবে, যেমনটি ছিল ১৭৮৩ সাল থেকে। দনবাসের জন্য একটি বাস্তবসম্মত সমাধান বের করা হবে (যেমন ভৌগলিক বিভাজন, স্বায়ত্তশাসন, বা যুদ্ধবিরতি লাইন)। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যুদ্ধ বন্ধ হবে, রুশ সৈন্যরা ইউক্রেন ছেড়ে যাবে এবং ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এবং অন্যান্য দেশগুলি দ্বারা নিশ্চিত করা হবে।
সর্বোপরি, ইউক্রেনের সরকার এবং জনগণ রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়ে দেবে ইউক্রেন আর প্রক্সি যুদ্ধের রণক্ষেত্র হবে না। গভীর অভ্যন্তরীণ বিভাজনের মুখে, জাতিগত বিভাজনের উভয় দিকের ইউক্রেনীয়রা শান্তির জন্য চেষ্টা করবে, এই বিশ্বাস পরিহার করবে যে বহিরাগত শক্তি তাদের আপোষ করার প্রয়োজন থেকে দূরে রাখবে।
অনুবাদ: আনিস আহমেদ
(জেফরি ডি শ্যাক্স অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক এবং পাবলিক পলিসি বিশ্লেষক, যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্টের পরিচালক)