Penal law of ancient society was not the law of crime but law of wrong.
-Henry Maine
সমাজে অধিকাংশ মানুষ প্রচলিত আইনকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে অভ্যস্ত নন। উল্টো আইনকে নৈতিক বিবেচনা করে নিজ বিশ্বাসে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন। এমন বিশ্বাস জনমানসে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রও কার্যকর ভূমিকায় থাকে। প্রচলিত যে কোন আইন বিদ্যমান রাষ্ট্র বা শাসকশ্রেণীর রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতিফলন। আইন যেমন রাজনীতি বিচ্ছিন্ন নয়, তেমানি অপরাধও নয়। অপরাধের রাজনৈতিক চরিত্র আছে। অন্য দিকে আইন এবং নৈতিকতা এক নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু আইনকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে আইনে নৈতিকতা আরোপের চেষ্টা করা হয়। এভাবে দীর্ঘদিন একই আইন চর্চা করলে বা প্রয়োগের ফলে আইন নৈতিকতা বিরোধী হলেও সমাজের অসচেতন অবস্থায় সেই আইন নৈতিক অবস্থান তৈরী করে নেয়। আইনের রাজনৈতিক মর্মবস্তুটা এখানেই।
প্রায় অবিকৃত রূপে ১৬০ বছর আগের প্রণীত দণ্ডবিধি ভারতীয় উপমহাদেশে প্রতিরোধহীনভাবে শাসন করছে। সমাজ ১৬০ বছর পূর্বে নেই। কিন্তু দণ্ডবিধি অপরিবর্তিত অবস্থায় টিকে আছে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ তার পূর্ববর্তী রাষ্ট্র পাকিস্তান হতে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু আইন ও বিচার ব্যবস্থায় মৌলিক কোন পরিবর্তন আনেনি। ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। যদিও এই তিনটি রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ব্যবস্থায় পরিমাণগত এবং অবস্থাভেদে খুব বেশি না হলেও কিছু গুণগত পরিবর্তন এসেছে। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক, সংবিধানকে সাধারণভাবে আইনের জননী বলা হয়। অথচ সংবিধানের অধীনস্থ প্রচলিত আইন সংবিধানের চেয়েও লক্ষগুণ শক্তিশালী। সেইক্ষেত্রে নির্দ্বিধায় বলা যাচ্ছে, সমাজকে সংবিধান বা শাসনতন্ত্র শাসন করে না, শাসন করে প্রচলিত আইনই।
আইন ও বিচার ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত অনেকেই বলেন, যেহেতু বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র এখনও দুর্বল, সে বিবেচনায় ব্রিটিশদের তৈরী আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখার যৌক্তিকতা রয়েছে। এভাবে যাঁরা বলেন, তাঁরা ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক মানসিকতা ধারণ করেন অবশ্যই। একইসাথে আইনের যে নৈতিকতা উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থা ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরীতে ভূমিকা রাখে ও তার মতাদর্শিক আয়োজন করে এরা সেই দলের বুদ্ধিজীবী নিঃসন্দেহে।
বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর নিকট দণ্ডবিধির যে গুরুত্ব ও মূল্য সেটা লক্ষ্য করা দরকার। দণ্ডবিধি বলা চলে বাংলাদেশের অপরাধ সংক্রান্ত মৌলিক আইন। যে যে অপরাধ সমাজে ঘটতে পারে এবং ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে সেগুলোর মূল উপাদান এবং ভিত্তি দণ্ডবিধিতে আছে। অপরাধের ক্ষেত্র বা মাত্রা তীব্র বা গভীর হলে বিশেষ যে আইনগুলো পরিস্থিতি অনুযায়ী তৈরী করতে হয়েছিল তার মূলেও দণ্ডবিধির নৈতিক ভিত্তি আছে, সেটা প্রযুক্তিগত অপরাধের ক্ষেত্রেও। স্বাধীন বাংলাদেশে যেখানে ব্রিটিশ প্রণীত আইনে উল্লেখিত অপরাধের মতো অপরাধ ঘটবে কিনা বা একইরকমের অপরাধ থাকবে কিনা- এই সকল বিষয়ে গুরুত্ব না দিয়ে যখন শাসক কর্তৃক হুবহু সেই আইনকে অপরিবর্তনীয় অবস্থায় প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন এই ধারণা সঙ্গত যে- বাংলাদেশ পূর্ব অপরাধগুলো সংঘটনের অনিবার্যতা স্বাধীন বাংলাদেশে তৈরী হয়েছিল এবং ব্রিটিশরা তাদের শাসন বিরোধী যে রাজনৈতিক কাঠামোর নিরাপত্তার জন্য দণ্ডবিধি তৈরী করেছিল বাংলাদেশেও একই শাসন ও রাজনীতি বলবৎ আছে। সুতরাং, স্বাধীন বাংলাদেশে দণ্ডবিধিকে প্রতিষ্ঠায় শাসকদের অবস্থান আইন ও অপরাধ সম্পর্কে বৃটিশদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে নেই। বরং আজ পর্যন্ত শাসকরা সেই রাজনৈতিক উত্তরাধিকারই বহন করছে।
দণ্ডবিধিকে সাদামাটা চোখে ধর্ম নিরেপক্ষ মনে হয়। এটা ঠিক যে, দণ্ডবিধিতে সুনির্দিষ্ট কোন ধর্মের নাম উল্লেখ নেই। কিন্তু ব্রিটিশরা দণ্ডবিধির অধিকাংশ আইন কমন ল’ (Common Law) হতে এনেছে। কমন ল’ ইংল্যান্ডের তৎকালীন সামাজিক ব্যবস্থা ও বিচারকদের বিচার ব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গিজাত আইন। দণ্ডবিধিতে খ্রিস্টীয় নীতিবোধের প্রাধান্য সুস্পষ্ট। ব্রিটিশ পূর্ব ভারতে, সুলতানী ও মোঘল আমলে, বিচার ব্যবস্থায় খন্ডিতভাবে শরীয়া আইনের উপাদান ছিল। ব্রিটিশদের দণ্ডবিধির মূল্যবোধে অভারতীয় উপাদান থাকা সত্ত্বেও সচেতন মুসলিম মানস কিন্তু দণ্ডবিধির বিরোধিতা করেনি। বরং এক মেনে নিয়েছে। এর কারণ, খ্রিস্টীয় ও মুসলিম ধর্মীয় মূল্যবোধের উৎস একেশ্বরবাদ এবং উভয়ই কেতাবী ধর্ম। দেশে দেশে খ্রিস্টীয় ও মুসলিম ধর্মের বিশ্বাসীদের জাতিগত রাজনৈতিক ভিন্নতা থাকলেও ভারতবর্ষে ভারতীয় দণ্ডবিধির ক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক মূল্যবোধ অভিন্ন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে ও দণ্ডবিধিতে একেশ্বরবাদী ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রভাবে ভারতীয় জাতিসমূহের যে সামাজিক প্রথা আইন হিসেবে জাতিসমূহের নৈতিক মানদণ্ড হিসেবে কার্যকর ছিল সেটা কার্যতঃ উচ্ছেদ হয়ে গেল। সাবেক সকল প্রথাই গণতান্ত্রিক – তা নয়। কিন্তু একটা সমাজ যে সাধারণ প্রক্রিয়ায় বিবর্তিত বা বিকশিত হয়- ব্রিটিশদের ভূমি ব্যবস্থাপনা ও ভূমি আইন এবং ‘অপরাধ দমনের আইন’ ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার সেই সামাজিক গতি প্রকৃতিকে বিনষ্ট করেছে। সুলতানী বা মোঘল শাসনামলে শরীয়া আইন প্রয়োগের ক্ষেত্র সীমিত ছিল। মোঘলদের শাসিত সমগ্র অঞ্চলেও শরীয়া আইন কার্যকর হয়নি। সেটার সুনির্দিষ্ট কারণ হচ্ছে, সুলতানী বা মোঘল শাসকরা ধীরে ধীরে ভারতীয় সংস্কৃতির ভেতর মিশে যাচ্ছিল। দু’একজন শাসকের কথা বাদ দিলে অধিকাংশ শাসক এবং শাসকের অংশীদাররা অনারোপিত প্রক্রিয়ায় ভারতীয় হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে ব্রিটিশরা কখনই ভারতীয় হতে চায়নি। বরং ভারতবাসীর প্রতি এক বর্বর দৃষ্টিভঙ্গি শাসনের শেষ দিন পর্যন্ত ধরে রেখেছিল।
বিধিবদ্ধ আইনের রাজনৈতিক বিকাশ শুরু হয়েছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিকাশের সাথে। আধুনিক জাতি বা জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের বা বিকাশের প্রয়োজনে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সংবিধান এবং শাসনের জন্য বিধিবদ্ধ আইনের প্রয়োজন ঐতিহাসিক কারণে হয়েছিলো। পরবর্তীতে এটাই দুনিয়াব্যাপী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পূর্বে প্রথা এবং ধর্ম বা শাস্ত্রীয় বিধি সাধারণভাবে আইনের মতো কার্যকর ছিল। ধর্মীয় বা শাস্ত্রীয় বিধি বিধিবদ্ধ। কিন্তু এই বিধির সাথে সমাজের নৈতিক বিরোধ সবসময় ছিল এবং আজও আছে। তাছাড়া ধর্ম বা শাস্ত্র আজকের মতো একরাষ্ট্রিক ভূমিকায় কার্যকর ছিল না। মহাদেশীয় ক্ষেত্রে খুব অল্প ভিন্নতা দেখা গেলেও রাজ্য বা সাম্রাজ্য শাসনের অস্থিরতা সাম্রাজ্য জুড়ে শাস্ত্রের প্রয়োগ কাঠামোগতভাবে কঠোর ছিল না। হাজার বছর ধরে সমাজ শাসিত হয়েছে উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত প্রথা বা রীতি নিয়ে। সামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তন, ধর্মের আবির্ভাব, শাসকের পরিবর্তন সমাজগুলোতে স্থায়ী আইনী কাঠামো তৈরী করতে পারেনি। যেটা আজকের এক রাষ্ট্রিক কাঠামোতে সম্ভব হয়েছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় শ্রেণী কর্তৃত্বের ঐতিহাসিক বাস্তবতা হলো এই যে আইনই নিপীড়নের বৈধতা দেয়।
আইনের সাথে অপরাধের পারস্পরিক সম্পর্ক থাকে, ব্যপারটা আপাতভাবে বুঝে উঠা মুশকিল। আমরা ইতোপূর্বে বলেছিলাম, আইনের যেমন রাজনৈতিক চরিত্র আছে, অপরাধেরও রাজনৈতিক চরিত্র থাকবে। মানুষ জন্মগত অপরাধী হয় না। সমাজ বা রাষ্ট্রীয় কাঠামো মানুষকে অপরাধী করে তোলে। অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, গাত্রবর্ণগত, জাতি, লিঙ্গ, আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য, নিপীড়ন বা অসাম্য মানুষকে যে অবদমিত পরিস্থিতির ভেতর ঠেলে দেয়- এই অবদমিত অবস্থাই অপরাধ উৎপাদনে সহায়তা করে সরাসরি। অন্যদিকে রাষ্ট্রও অপরাধ উৎপাদন করে এবং অপরাধের ক্ষেত্র তৈরী রাখে। যাতে করে অবদমিত বা অবদমন ছাড়াও যে কেউ অপরাধে জড়িত হতে পারে। অপরাধ যেমন সমাজকে ভীত রাখে, নৈরাজ্য তৈরী করে এবং এর প্রতিকারের সম্ভাবনা দেখা না গেলে সমাজ মানসে গভীর হতাশা সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের মতো সাবেক ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোতে এমন চিত্র সাধারণভাবে দেখা যাবে। রাষ্ট্র অপরাধের অজুহাতে নিপীড়নমূলক আইন বা নতুন আইন সৃষ্টি করে এবং অনেকসময় রাষ্ট্র নিজেই (বে)আইনী কার্যক্রমের ঘোষণা দিয়ে সরাসরি নিপীড়ন চালায়। হতাশাগ্রস্থ সমাজ নতুন আইন বা রাষ্ট্রের বে-আইনী কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ সমর্থন জানায়। এর ফলে অপরাধ ও আইন সম্পর্কে জনগণের নৈতিক সমর্থন এবং নীতিবোধ ধীরে ধীরে তৈরী হয়। বেশিরভাগ মানুষ উপলব্ধি করতে শিখে সমাজে কিছু মানুষ জন্মগতভাবেই অপরাধী! ১৬০ বছরের পুরাতন দণ্ডবিধি ভারতীয় উপমহাদেশে শাসকদের রাজনৈতিক প্রয়োজনে টিকে থাকার বাস্তবতা এই পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভব হয়েছে।
দণ্ডবিধি অপরাধ ও শাস্তি সম্পর্কিত বিধিবদ্ধ আইনের বই। এখানে অপরাধের প্রতিপক্ষ রাষ্ট্র, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণায়, রাষ্ট্র হচ্ছে সার্বভৌম ভূখণ্ডে বসবাসরত জাতি বা জনগণের শাসনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। এর মানে রাষ্ট্র Public Interest বা জনস্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে। Public Interest-এর স্বার্থে রাষ্ট্র আইনের বৈধ কর্তৃত্বকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইন তৈরী করবে, প্রয়োগ করবে এবং শাস্তি প্রদান করার ক্ষমতা ধারণ করবে। এখানে অপরাধের দায় অপরাধীর ব্যক্তিগত। আইন প্রয়োগকারী বৈধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্র ব্যক্তির অপরাধের প্রতিপক্ষ। ফৌজদারী দৃষ্টিতে অপরাধকে উল্লেখ করা হয়েছে Public Interest-এর বিরুদ্ধে বেআইনী কোন কর্মকাণ্ড। অপরাধ সমাজ বা সমাজের বিদ্যমান রাজনীতি বহির্ভূত কর্মকাণ্ড, একান্তই ব্যক্তিগত; অপরাধের দায় সমাজ বা রাজনীতির নয়। ব্যক্তিই অপরাধের জন্য দায়ী- এটাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও অপরাধ সম্পর্কিত ঔপনিবেশিক আইন ব্যবস্থার মূল দৃষ্টিভঙ্গি।
১৮৩০ সালে ব্রিটিশ ভারতে দণ্ডবিধি প্রণয়নের জন্য ল’ কমিশন গঠন করা হলেও এর বাস্তবায়ন হয় ১৮৬০ সালে। এর কয়েকবছর পূর্বে ১৮৫৭ সালে ভারত জুড়ে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বা সিপাহী বিদ্রোহ হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে ক্ষমতা নিয়ে ১৮৫৮ সালে সরাসরি ব্রিটিশ রাজ ভারতে সাম্রাজ্যিক শাসন শুরু করতে করতে ভারতীয় জনগণ বিশেষ করে সাঁওতাল বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ এবং ভারত জুড়ে বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহ ব্রিটিশদের কৃষির রাজস্ব আদায় এবং কাঁচামাল লুণ্ঠনকে রীতিমতো হুমকির মধ্যে ফেলেছিল। ১৭৭০ দশক থেকে প্রণয়ন করা বিভিন্ন ভূমি আইন দিয়ে কৃষকদের দমন ও রাজস্ব আদায় করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেইসময় ভারতে অন্যান্য বিদ্রোহগুলো অঞ্চল ভিত্তিক সংঘটিত হয়েছিল, কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহ ছিল আকারের দিক থেকে বৃহৎ এবং এর প্রভাব ছিল সমগ্র ভারত জুড়ে। ব্রিটিশ রাজ আর অপেক্ষা না করে সাম্রাজ্যিক শাসনকে নিরাপদ করে তুলতে তড়িঘড়ি করে ১৮৬০ সালে দণ্ডবিধি প্রণয়ন করে। এর মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট পুলিশ আইন (১৮৬১), সাক্ষ্য আইন (১৮৭২), অস্ত্র আইন (১৮৭৮), জেল আইন (১৮৯৪), ফৌজদারি কার্যবিধি (১৮৯৮), দ্য প্রিজনারস অ্যাক্ট (১৯০০) আইনগুলো ব্রিটিশ কর্তৃক শুধু ভারতে প্রণীত হয়। যে প্রেক্ষাপটে দণ্ডবিধি এবং উপরোল্লিখিত আইনগুলো প্রণয়ন করা হয়েছিল, এর উদ্দেশ্যই ছিল দমন। ১৮৫৮ সালে ইংলান্ডের রাণী সরকারিভাবে ভারতকে ব্রিটিশ শাসনের অংশ করে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে ভারত শাসনের আইনগত বৈধতা অর্জন করে নেন। কোম্পানী যেভাবে ১৮৫৮ সালের পূর্বে ভারত শাসন করেছিল, সেই শাসনের কোন সাংবিধানিক বৈধতা ছিল না। সাংবিধানিক বৈধতা না থাকায় রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ১৮৫৮ সালের পর ১৯৪৭ পর্যন্ত ভারত ছিল বৃটেনের সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত রাষ্ট্র। ভারতীয় জনগণের ‘অপরাধ’ দমনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা ‘আইনকে’ বৈধতা দিয়েছে নির্যাতনে ও নিপীড়নে এবং ভারত থেকে সম্পদ লুণ্ঠনে। মূলতঃ ভারতবর্ষে অপরাধকে রাজনৈতিকভাবে দেখার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ইতোপূর্বে ছিল না। ইংরেজ শাসনপূর্ব ভারতে অপরাধকে সামাজিকভাবে ঘৃণা করা হতো- এটা সত্যি, কিন্তু এই ঘৃণার ব্যাপারটা ছিল নৈতিকতার মানদণ্ডে অপরাধীকে প্রতিপক্ষ করে নয়।
অপরাধ সম্পর্কিত আইন শুধুমাত্র অপরাধ সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গিই তৈরী করে না, একইসাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক, ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণীজাত ও সামাজিক সম্পর্ক, যৌনতা এবং যৌন ও লিঙ্গীয় দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্ক- প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন নৈতিকতা সৃষ্টি করে। পাশাপাশি রাষ্ট্র ও রাজনীতির ক্ষমতার কাঠামোর সাথে ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পর্ক কিভাবে হবে তার চিন্তার কাঠামো নির্মাণ করে; অর্থাৎ, অপরাধের আইন সে বিষয়ও নির্মাণ এবং নির্ধারণ করবে। দণ্ডবিধিতে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, ধর্ম ও ধর্মীয় বিষয়ে আলোচনা সমালোচনা, যৌন সম্পর্কের স্বাধীনতা, স্ব-হননের ইচ্ছে, সমালোচনার বিষয়ে মানের প্রশ্ন ইত্যাদির বিষয়ে আইন স্বাধীন চিন্তাকে সীমাবদ্ধ করেছে। দণ্ডবিধির নিজের একটা রাজনৈতিক শক্তি আছে। যে শক্তি ব্যক্তিকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে অবদমন করে। এখানে অবদমনের শিকার শুধুমাত্র অপরাধ করবার উদ্দেশ্য নিয়ে যিনি পরিকল্পনা করছেন সে ব্যক্তি নন, যিনি অবদমিত হয়েও অপরাধ বিযুক্ত থাকছেন উভয়েই অবদমনের শিকার হচ্ছেন। মানুষের বাঁচার আকাঙ্খায় বেঁচে থাকার জন্যে সামগ্রিক অর্থে একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ অত্যাবশ্যকীয়। ব্যক্তি যখন আইনী কাঠামোয় সংকীর্ণ পরিবেশে ইচ্ছা আকাঙ্খায় ও সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ হয় তখন ব্যক্তি বা সমাজ নিপীড়ন বা নির্যাতনমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও রাষ্ট্র হতে মুক্ত হতে পারে না। অপরাধের আইন হিসেবে দণ্ডবিধির রাজনৈতিক শক্তি এখানেই।
দণ্ডবিধি ঐতিহাসিকভাবে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার নীতি ও মূল্যবোধ বিরোধী আইনের বই এবং বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক জীবনের প্রতিবন্ধক। দণ্ডবিধির উল্লেখওোগ্য ধারাগুলো নিয়ে পরবর্তীতে আমরা আলোচনা করব।
৬.৪.২০২৩
(আমীর আব্বাস আইনজীবী, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন ,টাফ)