(১২/০৩/২০২৫)
বাঙলাদেশ লেখক শিবির কেন্দ্রীয় পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মুঈনুদ্দীন আহ্মদ এবং সাধারণ সম্পাদক কাজী ইকবাল এক বিবৃতিতে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে নারীদের ওপর চলমান নিপীড়ন, হেনস্তাকরণ ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে সমাজের সকল স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করেছেন। বিবৃতিতে তারা উল্লেখ করেন, যেকোনো গণঅভ্যুত্থানের একটা আশু ফলাফলের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব থাকে এবং এই দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবই অনেক ক্ষেত্রে সমাজ পরিবর্তনে নির্ধারক ভূমিকা পালন করে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখা যায়, এর আশু ফল হিসেবে চুয়ান্নর নির্বাচনে মুসলিম লীগ পূর্ববঙ্গ থেকে উৎখাত হয়ে গিয়েছিল, যে মুসলিম লীগ ছিল সমগ্র ভারতবর্ষের মধ্যে এই পূর্ববঙ্গেই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়, ছেচল্লিশ সালের নির্বাচনে এখানকার জনগণের মধ্যে থেকেই তারা সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিল।
কিন্তু বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং তার আগেপরে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি থেকে শুরু করে সরকারের নির্যাতনমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে তারা এ দেশের রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে বিদায় নিয়েছিল, চুয়ান্নর নির্বাচনের পরে কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করলেও রাজনীতিতে তাদের কোনো প্রভাবক ভূমিকা আর ছিল না। কিন্তু এর মনোসামাজিক ফল ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি বাঙালি মুসলমানের মোহমুক্তি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সুদূরপ্রসারী ফল হিসেবে তারা এ ভূ-খণ্ডের সন্তান হিসেবে নিজেদের আত্মপরিচয় লাভ করেছিল, তাদের মনোজগতে সংঘটিত হয়েছিল ‘স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’। ফলশ্রুতিতে পরবর্তীকালে আরবি অক্ষরে বাংলা প্রচলনের প্রচেষ্টা, বাংলা ভাষার তথাকথিত ইসলামিকরণ, সরকারিভাবে রবীন্দ্রচর্চার বিরোধিতা, বাষট্টি সালের শিক্ষা সংস্কার এসবের বিরুদ্ধে এদেশের জনগণ রুখে দাঁড়িয়ে সকল চক্রান্ত নস্যাৎ করেছিল। এগুলোর পেছনে কাজ করেছিল ভাষা আন্দোলনের গণতান্ত্রিক চেতনা।
একইভাবে চব্বিশ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের আশু পরিণতি শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের দীর্ঘ সাড়ে পনের বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান হলেও এর সুদূরপ্রসারী মনোসামাজিক ফল হিসেবে সমাজের অবৈরী দ্বন্দ্বসমূহের প্রান্তিকীকরণ একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়, যার অন্যতম দিক হলো সমাজে হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব এবং নারী-পুরুষ দ্বন্দ্বের অবস্থান প্রান্তিক পর্যায়ে চলে যাওয়া। আমাদের সমাজে হিন্দুর সাথে মুসলমানের, নারীর সাথে পুরুষের বিভিন্ন অবৈরী দ্বন্দ্ব রয়েছে- সমাজে বৈষম্যমূলক শাসনব্যবস্থা বজায় রাখার জন্য শাসকগোষ্ঠী যেগুলোকে কাজে লাগিয়ে থাকে। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে এই দুইটি দ্বন্দ্বেরই প্রান্তিকীকরণ ঘটেছিল। এই লড়াইয়ে মুসলিম জনতার পাশাপাশি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ, পুরুষের পাশাপাশি অনেক নারী রাস্তায় নেমে এসেছিলেন।
আন্দোলনের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো উপাসনালয় আক্রান্ত হয় নি, হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতনও হয় নি, আন্দোলনরত নারীদের পরিধেয় পোশাক নিয়ে সমালোচনা থেকে শুরু করে হেনস্তাকরণ, হয়রানি, ধর্ষণ অথবা ধর্ষণের হুমকি এগুলো খুবই গৌণ মাত্রায় ছিল। কিন্তু লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো, ৫ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার উৎখাত এবং শেখ হাসিনার ভারতে পলায়নের পর এ জাতীয় কর্মকাণ্ড উল্লেখযোগ্য মাত্রায় শুরু হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের উপাসনালয়ে আক্রমণ হলো, তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন এলো। হিন্দু জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সংগঠন এসব ঘটনার ওপর দাঁড়িয়ে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত করে সমাবেশ করল। ভারতের মিডিয়ায় ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এসব বিষয়ে অপপ্রচার করা হলো। এ দেশের জনগণ সম্মিলিতভাবে এ জাতীয় আক্রমণ ও চক্রান্ত প্রতিহত করেছেন।
এ মুহূর্তে আবার দেখা যাচ্ছে, পথচলতি মেয়েদের ওপর আক্রমণ নতুন উদ্যমে শুরু হয়েছে। তাদের পোশাক নিয়ে সমালোচনা, ব্যঙ্গ, ধর্ষণ; এমনকি রাস্তাঘাটে হেনস্তা করার ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে শিশু কন্যা আছিয়া ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতন যেভাবে ব্যাপক আকারে সংঘটিত হচ্ছে এসবের পেছনে কোনো নিগূঢ় পরিকল্পনা কার্যকর থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। কায়েমী স্বার্থবাদী মহল সমাজের মানুষের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চায়, তারা যাতে ঐক্যবদ্ধ থাকতে না পারে, পরস্পরের ওপর আস্থা না রাখতে পারে, এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই এ ধরনের চক্রান্ত বাস্তাবায়ন করা হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকেও নারী-নিপীড়কদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। সভা-সমাবেশ এবং ওয়াজ-মাহফিলে এক শ্রেণীর ধর্মীয় বক্তা কর্তৃক চরম নারী-অবমাননামূলক বক্তব্য প্রদানের বিষয়েও জোরালো আইনি পদক্ষেপ থাকা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের মতো পশ্চাৎপদ চিন্তাকাঠামো বিশিষ্ট রাষ্ট্রে পোশাকের কারণে নারীর সমালোচনা, হয়রানি, যৌন নির্যাতনের পক্ষে কিছু মাত্রায় সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা লক্ষ করা যায়। এই গ্রহণযোগ্যতার ওপর দাঁড়িয়েই কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী ও তাদের পক্ষে কাজ করা লুম্পেনের দল এই কাজে প্রবৃত্ত হয়েছে যাতে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের অর্জনকে নস্যাৎ করে বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্মাণের পথকে কণ্টকাকীর্ণ করা যায়। বিবৃতিতে দেশের গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক মহলসহ সকল স্তর, শ্রেণী ও পেশার জনগণকে সকল প্রকার নারী ও শিশু-নিপীড়ন, বৈষম্য, যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি এসব সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডের পেছনে ক্রিয়াশীল স্বার্থবাদী মহলের মুখোশ উন্মোচনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়।
বার্তা প্রেরক
আবিদুল ইসলাম
সাহিত্য সম্পাদক