Homeদক্ষিণ এশিয়াভারতে ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

ভারতে ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

-

ইতিহাসের স্রষ্টা হিসেবে বলা হয়ে থাকে হেরোডোটাসকে (খ্রি.পূর্ব ৪৮৪-৪২৫)। তাঁর আগে মানব সমাজের কোনো লিখিত ইতিহাস ছিল না। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১ থেকে ৪০৪ পর্যন্ত প্রাচীন গ্রিসের এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। যুদ্ধে এথেন্সের পরাজয় হয়। এই যুদ্ধে এথেন্সের বহু সৈনিকের মৃত্যু হয়। এইসব সৈনিকদের বীরত্বপূর্ণ লড়াই এবং প্রাণ উৎসর্গের বিষয়টিকে লিখে রাখার তাগিদ থেকে হেরোডোটাস সমগ্র ঘটনাকে লিপিবদ্ধ করেন। সেই থেকেই ইতিহাসের জন্ম এবং হেরোডোটাসেক ইতিহাসের জনক বলা হয়।

একটি রাষ্ট্রের জন্য জীবন দানকে কেন্দ্র করে এবং তাদের স্মৃতি সব সময়ের মানুষদের মধ্যে যেন বেঁচে থাকে এবং অনুপ্রাণিত করে – এক্ষেত্রে ইতিহাস সাহায্য করে এসেছে। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক জ্ঞান বর্তমান ও ভবিষ্যতের পাথেয়। কিন্তু দেখা গেছে শাসক শ্রেণী বিভিন্ন ঐতিহাসিক সত্যকে বিকৃত করে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগিয়েছে। নিজেকে শাসনকে গৌরবান্বিত করার জন্য নিজেদের লোক দিয়ে ইতিহাস লেখার কাজটি গণবিরোধী শাসকরা সব সময়ই করে এসেছে। কিন্তু তাতেই প্রকৃত ইতিহাস ধামাচাপা পড়েছে? না, পরবর্তীকালে ওইসব বিকৃতিগুলো উদঘাটনের কাজটিও ঐতিহাসিকরা করেছেন এর থেকে বোঝা যায় যে, ইতিহাস বিকৃতি ও অসত্য ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াশীল শাসকরা যতই চেষ্টা করুক না কেন তার স্থায়িত্ব স্বল্পমেয়াদি। পৃথিবীতে এর উদাহরণ ভুরি ভুরি।

ভারতের বর্তমান হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শাসকদল বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন সময় ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসকে হিন্দুত্ববাদী ভাবধারায় লেখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এই বিকৃতির প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে ভারতের মুসলমান ধর্মাবলম্বী শাসকদের এবং তাঁদের শাসনকে হেয়প্রতিপন্ন করা। এক্ষেত্রে তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে ভারতে মুঘল শাসন। মুঘল শাসকদের ভারতের ইতিহাসে বেশি করে ‘গৌরবান্বিত’ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে বিজেপির নেতারা ‘জাতীয়তাবাদ’কে সামনে এনে প্রচার করছেন ভারতের ইতিহাস নতুন করে লিখতে হবে। এই প্রশ্নটা বারবার তুলে ধরছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।

গত ১৪ জানুয়ারি দিল্লির ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে সিডি দেশমুখ স্মারক বক্তৃতায় বক্তব্য রাখার জন্য বিশিষ্ট প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ রোমিলা থাপারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আলোচনার বিষয় ছিল- আমাদের ইতিহাস, তাদের ইতিহাস, কাদের ইতিহাস। এ বিষয়ে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৬ জানুয়ারিতে প্রথম পাতায় গুরুত্বসহকারে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

এই স্মারক বক্তৃতার আগে বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র সোশ্যাল মিডিয়ায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও দিল্লির পুলিশকে এই মর্মে অভিযোগ করেন যে, রোমিলা থাপার বক্তৃতার পর শহরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সে কারণে তিনি সেই অনুষ্ঠানের আয়োজকদের বক্তৃতা বাতিলের দাবিও জানান। কপিল মিশ্রের অভিযোগ- ‘রোমিলা থাপার মতো ব্যক্তিরা মিথ্যা ইতিহাস লেখেন, ভুয়ো তথ্য দিয়ে হিন্দুদের গণহত্যার পক্ষে যুক্তি দেন। এই অনুষ্ঠানের লক্ষ্যও হলো বিদ্বেষপূর্ণ মিথ্যা প্রচার।’

বিজেপি সেই নেতার হুশিয়ারির কারণে দিল্লি পুলিশ অনুষ্ঠানস্থলে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। সেখানে আমন্ত্রিত অতিথি ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তারপরও অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত মিলনায়তন সকল আসনই পরিপূর্ণ ছিল। অনুষ্ঠানে ৯১ বছর বয়স্ক ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার ঐতিহাসিক এরিক হবসনকে উদ্ধৃত করে বলেন-

‘ইতিহাসের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের সম্পর্ক আর আফিমের সঙ্গে হেরোইন আসক্তির সম্পর্কটা একই রকম। আফিমের নেশা যখন মাথায় চড়ে, মাদকাসক্ত তখন গৌরবময় অতীত নিয়ে রূপকথার জাল বোনে।’

বিজেপির ঐতিহাসিকরা রাজপুতদের সঙ্গে মুঘলদের লড়াইকে হিন্দু-মুসলমানের লড়াই বলে চালিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করছে। এর বিরুদ্ধে রোমিলা থাপার ঐতিহাসিক তথ্য উল্লেখ করে বলেন, মুঘলদের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের ভার ছিল দেওয়ান রাজা টোডরমহলের হাতে। হলদিঘাটে মুঘলদের সঙ্গে রাজপুতের যুদ্ধে আকবরের সৈন্যদের যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন রাজা মান সিংহ। অন্যদিকে মহারাজা প্রতাপ সিংহের সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন শের শাহ সুরির বংশধর হাকিম খান সুরি। রোমিলা থাপার প্রশ্ন এরপরও কীভাবে মুঘল ও রাজপুতদের লড়াইকে শুধুমাত্র হিন্দু-মুসলমানের লড়াই বলার সুযোগ থাকে? এভাবে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন পেশাদার ইতিহাসবিদদের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্বার্থসিদ্ধির জন্য বানানো গল্প ও রূপকথাকে ইতিহাস হিসেবে চালানোর কোনো সম্পর্ক নাই।

অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন সম্প্রতি বৈদিক অঙ্কের গৌরবময় ঐতিহ্য নিয়ে মাতামাতি প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন যে, বৈদিক অঙ্ক বলতে কিছুর অস্তিত্ব বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ বেদে অঙ্কের স্থান খুবই সামান্য।

রোমিলা থাপার উল্লেখ করেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় যে জাতীয়তাবাদ গোটা দেশকে একত্রিত করেছিল তার সঙ্গে হিন্দু-মুসলমান জাতীয়তাবাদের পার্থক্য অনেক। ওই হিন্দু-মুসলমান জাতীয়তাবাদের জন্য ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান ও হিন্দুদের জন্য ভারত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। আজকের ভারত ক্রমে হিন্দুরাষ্ট্রের কিনারা এসে দাঁড়িয়েছে। এটা হচ্ছে ঊপনিবেশিক পরিকল্পনার সাফল্যের নামান্তর।

তিনি আরও উল্লেখ করেন- মোদি-অমিত শাহরা সবসময় মুঘলদের ‘ধর্মান্ধ আক্রমণকারী’ হিসেবে উল্লেখ করে থাকে। বিজেপি-আরএসএস মুঘল-মুসলমান শাসকদের ভারতের ‘হিন্দু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ ধ্বংসের অভিযোগ করেন। তাদের এই মিথ্যা তথ্য ও উস্কানিতেই অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের পর কাশী, মথুরায় মসজিদের জায়গায় মন্দির ছিল বলে দাবি করছে। কয়েক মাস আগে দিল্লির আদালতে কুতুব মিনারের পরিসরে পুজো করার অনুমতি চেয়ে মামলাও করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে রোমিলা থাপার উল্লেখ করেন যে, চতুর্দশ শতাব্দিতে কুতুবমিনার বাজ পড়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে সময় মিনারটি মেরামতের জন্য হিন্দু রাজমিস্ত্রিরা মিনারের গায়ে হিন্দিতে ও ভুল সংস্কৃতিতে তাঁদের দেবতা বিশ্বকর্মা ও গণেশের কথা খোদাই করেছিলেন। এর থেকে প্রমাণ হয় যে, তাঁদেরকে জোর করে কাজ করতে বাধ্য করা বা হিন্দুদের ধর্মান্তরণ হয়নি। কিন্তু এতো বছর পর ওইসব খোদাই দেখিয়ে হিন্দু সংগঠনগুলো দাবি করছে, কুতুব মিনার হচ্ছে আসলে ‘বিষ্ণু স্তম্ভ’।

বিজেপি ও আরএসএস’র বর্তমান ‘লাভ জিহাদ’-তত্ত্বেরও রোমিলা থাপা প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর যুক্তি হচ্ছে মুঘলদের সঙ্গে রাজপুত পরিবারের বিয়ে হয়েছিল। সে সময় ‘লাভ জিহাদ’ ছিল না। এইসব বিয়ে জোর করে করা হয়েছিল বলে কোনো আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথায় তেমন উল্লেখ পাওয়া যায় না। সে কারণে এসব দাবির পেছনে ঐতিহাসিক সত্য নাই।

ভারতীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট অভিনেতা নাসিরউদ্দিন শাহ-এর ইতিহাসে মুঘল ও অন্যান্য শাসকদের বিষয়ে যা বলেছেন তা দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ২৫শে ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন- ‘মুঘলদের সবকিছুই যদি এত খারাপ, তাহলে তাজমহল, লালকেল্লা বা কুতুবমিনার সাজিয়ে রাখা হয়েছে কেন? ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হোক।’ তিনি উল্লেখ করেন যে, লালকেল্লাকে পবিত্র এবং এর স্থাপত্যকে কেন এক গুরুত্ব দেওয়া হয়? ওটা তো মুঘলদের তৈরি। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, ভারতের ইতিহাসে মুঘল ও ব্রিটিশদের গৌরবান্বিত করা হয়েছে কারণ ওই ইতিহাস ইংরেজদের লেখা। সে কারণে লর্ড হার্ডিঞ্জ, লর্ড কর্নওয়ালিশদের কথা এমনকি মুঘলদের কথা আমরা যেভাবে ইতিহাস পড়ে জানতে পারি সেভাবে গুপ্ত, মৌর্য, বিজয়নগর সাম্রাজ্যের কথা জানতে পারি না। অজান্তার গুহাচিত্র বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলকেও জানি না। সে কারণে ইতিহাসকে দেশীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা দরকার। কিন্তু তাই বলে কোনো শাসকদের মাথায় তুলে নাচবার বা খলনায়ক বানাবার প্রয়োজন নাই।

বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ভারতের বিভিন্ন স্থানের মুসলমান নাম পরিবর্তন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে উদ্দেশ্য করে বলেন- বিভিন্ন স্থানের মুসলমান নামগুলো পরিবর্তন করার আগে তাঁর নিজের নাম অমিত শাহ-এর শাহটাকে পরিবর্তন করা উচিত। কারণ ‘শাহ’ হচ্ছে ফারসি শব্দ।

এইভাবে ভারতের হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক দল বিজেপি-আরএসএস এর ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ একইসঙ্গে চলছে। হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ভারতের জনগণও যে সোচ্চার হচ্ছেন এইসব প্রতিবাদের মধ্যে দিয়েই তা প্রমাণিত হয়।

প্রসঙ্গক্রমে বাংলাদেশের শাসকদের ইতিহাস বিকৃতির বিষয়টিও চলে আসে। বর্তমান বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী দেশের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতাকে মুছে ফেলার বিষয়ে তৎপর। এই তৎপরতার অংশ হিসেবে তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচির মধ্যে বিষয় হিসেবে ইতিহাসকে একরকম তুলে দিয়েছে। এখানে বাংলাদেশের ইতিহাস বলতে একটি দলীয় কার্যকলাপ ও তাদের নেতাদের ভূমিকাকে প্রধান করে দেখাবার প্রচেষ্টা লক্ষ্যণীয়। এ দেশের ইতিহাস শুধুমাত্র ১৯৪৭ সালের পরবর্তী ঘটনা নয়। আমাদের ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের। গোটা সময় জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি শাসক ও ইংরেজ ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে জনগণের দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম। জনগণকে আজও দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে সুদূর অতীতের মতই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হচ্ছে। সংগ্রাম করতে হচ্ছে বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গেও। জনগণের এইসব বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামকে ধামাচাপা দেওয়ার কাজটিকে অতীতের শাসকদের মধ্যে বর্তমান শাসকরাও করে যাচ্ছে, বরং আরও বেশি করেই করছে। কারণ এই শাসকেরা জনবিচ্ছিন্ন, জনগণের ওপর শোষণ-নির্যাতনের বিকল্প আর কোনো পথ তাদের নেই। সে কারণেই বর্তমান শাসকরা ফ্যাসিবাদী রূপ ধারণ করেছে। ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম সঙ্গে এই শাসন বিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রামও তাই একীভূত হয়ে গেছে।

(কাজী ইকবাল সাধারণ সম্পাদক, বাঙলাদেশ লেখক শিবির)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Must Read

Culture and folk life of Bengal

বাংলার সংস্কৃতি ও লোকজীবন

বাংলার মানুষের ধর্ম চেতনা উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রকৃতির সঙ্গেই তার নিবিড় সম্পর্ক। ঋতুর সাথে মিলিয়ে তারা যেমন ফসল উৎপাদন করে, জমি চাষ করে,...