মানুষ জন্মগতভাবে যে জীবন ও জীবন-পরিস্থিতি লাভ করে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে না। সে উন্নততর জীবন ও পরিবেশ আশা করে। অনেকে তাদের চিন্তাশক্তি, কল্পনাশক্তি ও শ্রমশক্তি দিয়ে সম্ভবপর সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে সুখকর উন্নত অবস্থার রূপ ও প্রকৃতি কল্পনা করে এবং তা বাস্তবায়িত করতে চায়। এই উন্নত অবস্থায় মানুষের খাওয়া-পরার বিষয় যেমন থাকে, তেমনি থাকে পারস্পরিক সম্প্রীতির ও সর্বজনীন আনন্দের বিষয়াদিও। প্রকৃত-বাস্তবে অবস্থান করে চিন্তাশীল কল্পনাপ্রবণ আশাবাদী মানুষেরা মনে মনে সৃষ্টি করেন অভিপ্রেত উন্নত কল্পিত-বাস্তব। প্রকৃত-বাস্তবে অবস্থান করে মানুষ কল্পিত-উন্নত বাস্তবে উত্তীর্ণ হতে চায়। কোনো কোনো ঐতিহাসিক পর্যায়ে, বহুজনের অভিপ্রেত এই কল্পিত উন্নত-বাস্তব, সর্বজনীন কল্যাণকামী কোনো কোনো প্রতিভাবান ব্যক্তির প্রচেষ্টায়, বিপুল অধিকাংশ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ও কাম্য হয়ে ওঠে। এভাবে মানুষের মনের জগতে যে বাস্তব রূপ নেয়, তাই আদর্শ। মানববাদ, উপযোগবাদ, দৃষ্টবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, মার্কসবাদ, জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ এভাবেই সৃষ্ট আদর্শ।
আদর্শ মনের ব্যাপার বটে, তবে মন মানুষের দেহেরই অংশ। স্নায়ুমণ্ডলী ও মস্তিষ্ক মনের বস্তুভিত্তি বটে, তবে পরিবেশের স্পর্শ বা প্রভাব ছাড়া কারো মন জাগ্রত ও সক্রিয় হয়না। মানুষের মনকে তার দেহ থেকে এবং পরিবেশ থেকে আলাদা কোনো সত্তারূপে ভাবা সম্পূর্ণ ভুল। মস্তিষ্ক ও স্নায়ুমণ্ডলীর মতো পরিবেশও মানুষের মনের বস্তুভিত্তি।
বিবর্তনবাদীরা মনে করেন, মানুষ তার অনন্য জৈবিক সামর্থ্যের বলে প্রতিকূলতা, বাধা-বিপত্তি, ভুলত্রুটি ও ক্ষয়ক্ষতি অতিক্রম করে পর্যায়ক্রমে উন্নতি থেকে উচ্চতর উন্নতির দিকে এগিয়ে চলছে। উন্নতির পথে আদর্শ, আদর্শ-অভিমুখী পরিকল্পনা, কর্মসূচি ও কর্মনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য মানুষকে কাজ করতে হয়, কেবল ব্যক্তিগতভাবে নয়, সম্মিলিতভাবেও একবারে না পারলে বার বার চেষ্টা করতে হয় – জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। এরই মধ্যে দেখা দেয় বিজ্ঞান-প্রযুক্তির আবিষ্কার-উদ্ভাবন যা সহায়ক হয় মানুষের অগ্রযাত্রার। কোনো আদর্শই বাস্তব নয়, সব আদর্শই কল্পিত, আদর্শকে মানুষ বাস্তবায়িত করতে চায়। আদর্শ অবলম্বন করে মানুষ পৃথিবীকেই স্বর্গে উন্নীত করতে চায়। আদর্শ মানুষেই সৃষ্টি করে। আদর্শের অবলম্বন ছাড়া মানুষ পৃথিবীকে স্বর্গে উন্নীত করার কিংবা স্বর্গকে পৃথিবীতে নামিয়ে আনার কথা ভাবতে পারত না। অগ্রযাত্রার পথ আঁকাবাঁকা, চড়াই-উতরাইসঙ্কুল।
যারা সর্বজনীন আদর্শকে গুরুত্ব না দিয়ে কেবল নিজেদের স্বার্থকে বড় করে দেখে, তারা সর্বজনীন আদর্শের বাস্তবায়নে নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করে। তাতে সর্বজনীন আদর্শ ও সর্বজনীন কল্যাণের পথে অগ্রযাত্রা বিঘ্নসঙ্কুল ও সংঘাতময় হয়। আদর্শের উপলব্ধিতে ভুলত্রুটি ও মতপার্থক্যও ঘটে। হীন-স্বার্থবাদীরা আদর্শকে নানাভাবে বিকৃত করে। আদর্শ নিয়ে ন্যায়স্বার্থের সঙ্গে হীনস্বার্থের বিরোধ চলে-তাতে জয়-পরাজয় ঘটে। অগ্রগতি সরলরেখার মত সোজা হয় না।
আদর্শ প্রতিষ্ঠার সাধনা ও সংগ্রামে নানা জটিলতা আছে, ভুলত্রুটি ও ক্ষয়ক্ষতি আছে। আদর্শের ক্রমবিকাশ আছে, উত্থান-পতন আছে। আদর্শের অন্তর্গত নানা বিষয়ে প্রচলিত ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে নতুন ধারণা তার স্থলাভিষিক্ত হয়। সমাজ পরিবর্তনশীল, প্রকৃতিও পরিবর্তনশীল। এসবের দ্বারা আদর্শ প্রভাবিত হয়, এবং আদর্শগত সংস্কারের কিংবা পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয়।
আদর্শের অনুশীলন ধর্মের অনুশীলনের মতো হওয়া উচিত নয়। ধার্মিকেরা ধর্মপ্রবর্তকের আচার-আচরণ, কথাবার্তা, কাজ ও উপদেশাবলীকে এবং ধর্মগ্রন্থের বক্তব্যকে চিরসত্য এবং চিরকালের জন্য আচরণীয় বলে মনে করেন। দেশ-কালের পার্থক্যকে তাঁরা অল্পই বিবেচনায় ধরেন। ধর্মে বিবৃত অলৌকিক বিষয়াদিকে তাঁরা অকাট্য সত্য মনে করেন, সেগুলো নিয়ে তাঁরা বিচার-বিবেচনায় যান না। আদর্শের অনুশীলনে বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি, যুক্তি ও বিচার-বিবেচনা অপরিহার্য। কোনো আদর্শই চিরন্তর বা শাশ্বত হয় না। তবে আদর্শ দীর্ঘস্থায়ী হয়। আদর্শের পরিবর্তন ঘন ঘন হয় না, শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়ে যায়।
অবশ্য একালে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভিঘাতে রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন দ্রুততর হচ্ছে। যাঁরা কোনো আদর্শ অবলম্বন করে কাজ করতে করতে আদর্শ নিয়ে ধর্মবিশ্বাসীদের মতো অন্ধবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন, তাঁরা সাধারণত পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে তাঁদের বিশ্বাস পরিবর্তন করতে পারেন না। তত্ত্বজ্ঞানের অনুসারী অনেক ব্যক্তি অনেক সময় কাণ্ড-জ্ঞান পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেন। জাতীয় জীবনে কোনো আদর্শকে সফল করার জন্য সব সময় দরকার হয় উন্নত-চরিত্রের প্রজ্ঞাবান নেতৃত্ব। জনজীবনে দরকার হয় জাগ্রত নৈতিক চেতনা, বিজ্ঞানসম্মত নৈতিক বিবেচনা ও শ্রেয়োনীতি অবলম্বন। নেতৃত্বের সঙ্গে জনগণের মধ্যেও আদর্শ অবলম্বন করে চলার মনোভাব, জ্ঞান ও কার্যক্রম দরকার হয়। জনগণ চিন্তাহীন ও নিষ্ক্রিয় থাকলে আদর্শের ধারায় অগ্রগতি সম্ভব হয় না।
মানুষ সর্বজনীন কল্যাণের উদ্দেশ্যে আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। এর বিপরীত দিকও আছে। সর্বজনীন কল্যাণের বিরুদ্ধে হীন-স্বার্থবাদীরা কাজ করে। তারা আলাদা উদ্দেশ্য নিয়ে আলাদাভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকে। তারা নেতৃত্বের ভিন্ন ধারা সৃষ্টিতে তৎপর থাকে। তারা আদর্শের কথা বলে প্রতারণা করার জন্য। মানব প্রজাতির ইতিহাস জুড়ে দেখা যায়, হীন-স্বার্থবাদীরা সংখ্যায় অল্প হলেও প্রবল, আর জনসাধারণ সংখ্যায় বহু গুণ বেশি হলেও দুর্বল। জনসাধারণের অনৈক্যের কারণেই তারা সংঘবদ্ধ হীন-স্বার্থান্বেষীদের সঙ্গে পারে না। জনসাধারণ শক্তিশালী হয় ঐক্যবদ্ধ হয়ে। যথার্থ ঐক্যের জন্য নৈতিক শক্তি ও মহান নেতৃত্ব দরকার হয়। নেতৃত্বের জন্য দল গঠন করতে হয়।
জনসাধারণের ঐক্যের জন্য আদর্শ এবং আদর্শ-অভিমুখী পরিকল্পনা, কর্মসূচি ও কর্মনীতি – সেই সঙ্গে মহান নেতৃত্ব অপরিহার্য। নেতৃত্বের জন্য দলও অপরিহার্য। জনসাধারণকেই উদ্যোগী হয়ে নিজেদের মধ্য থেকে নিজেদের কল্যাণে মহান নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হয়। নেতৃত্ব সৃষ্টির জন্য জনসাধারণকে জাগ্রত ও সক্রিয় থাকতে হয়। দুর্বল হলে বঞ্চনা ভোগ করতেই হয়। দুর্বল ও বঞ্চিত থাকা অন্যায়। জনগণের কল্যাণে মহান নেতৃত্ব আপনিতেই দেখা দেয় না। নেতৃত্ব সম্পর্কে দার্শনিক হেগেলের একটি উক্তি:
যে জনসাধারণ যখন যেমন নেতৃত্বের যোগ্য হয়, সেই জনসাধারণ তখন ঠিক সেই রকম নেতৃত্বই লাভ করে।
আমাদের ধারণা, জনচরিত্র উন্নত হলে নেতৃত্বের চরিত্রও উন্নত হয়, আর নেতৃত্বের চরিত্র উন্নত হলে জনচরিত্রও উন্নত হয়। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে একেবারে নিখুঁত নির্ভুল কিছু পাওয়া যায় না, কিছু করাও যায় না।
প্রত্যেক জাতির জীবনে সব সময় ইতিহাসের চর্চা এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ দরকার। ইতিহাসের জ্ঞান ছাড়া কোনো বিষয়ের জ্ঞানই পর্যাপ্ত ও কার্যোপযোগী হয় না। ইতিহাসের প্রতি হীন-স্বার্থান্বেষীদের দৃষ্টিভঙ্গি আর জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হয়ে থাকে। মহান নতুন যুগ সৃষ্টির জন্য ভবিষ্যতের পরিকল্পনার সঙ্গে অতীত সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকেও পুনর্গঠিত করতে হয়। চিন্তাশক্তিকে প্রচলিত ধারণায় আচ্ছন্ন রেখে উন্নত নতুন ভবিষ্যত সৃষ্টির দিকে এগোনো যায় না। প্রত্যেক জেনারেশনকেই তার ইতিহাস নতুন করে জানতে হয়, এবং বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার-বিবেচনা করতে হয়। হীন-স্বার্থবাদীদের পক্ষে রচিত ইতিহাস আর জনগণের পক্ষে রচিত ইতিহাস এক হয় না। হীন-স্বার্থবাদীরা নিজেদের হীন-স্বার্থে নানাভাবে ইতিহাসকে বিকৃত করে। উন্নত জীবন ও উন্নত অবস্থার জন্য আদর্শ চর্চার সঙ্গে ইতিহাসের চর্চাও অপরিহার্য। অতীতের মহান দৃষ্টান্ত মানুষকে ভবিষ্যতের নতুন মহান সৃষ্টিতে অনুপ্রাণিত করে। উন্নত ভবিষ্যৎ সৃষ্টির জন্য ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ অপরিহার্য। স্বাধীন বাংলাদেশে ইতিহাসকে বিকৃত করার প্রবণতা অত্যন্ত প্রবল।
প্রত্যেক জাতির ভেতরেই প্রগতিশীল, রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি থাকে। প্রতিক্রিয়াশীলদের পরাজিত করার ও পরাজিত রাখার জন্য প্রগতিশীল ও রক্ষণশীলদের মধ্যে কর্মসূচি-ভিত্তিক ঐক্য দরকার হয়।
গত চার দশক ধরে পৃথিবীতে বিরাজ করছে আদর্শগত শূন্যতা। সভ্যতা ও প্রগতির ধারণাও হারিয়ে গেছে। নিজেদের দুর্বলতার কারণে এবং নতুন প্রযুক্তির অভিঘাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয়েছে (১৯৯১), কায়েমি স্বার্থবাদীরা প্রচলিত সব আদর্শকেই জনগণের জন্য আবেদনহীন করে ফেলেছে। পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গ ও তাদের সহযোগীরা কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনকেই গণতন্ত্র বলছে। নির্বাচনের গণ্ডী অতিক্রম করে গণতন্ত্র যাতে বিকশিত হতে না পারে তার জন্য প্রবর্তন করা হয়েছে সুশীল সমাজ সংগঠন (civil society organizations) ও এনজিও। বাংলাদেশে সুশীল সমাজ সংগঠনগুলো ও এনজিওগুলো অত্যন্ত সক্রিয়। বিশ্বায়ন প্রকৃতপক্ষে সাম্রাজ্যবাদের উচ্চতর স্তর। বিশ্বায়নের ভেতরে আছে নব্য-উদারবাদ, ধনবাদ, অবাধ-প্রতিযোগিতাবাদ, বহুত্ববাদ, দুর্বল জাতিসমূহের জন্য নিঃরাষ্ট্রবাদ (anarchism), শুন্যবাদ (nihilism) ইত্যাদি। এ-সবই গণবিরোধী।
ধনিক-বণিক ও সাম্রাজ্যবাদীদের গণতন্ত্রের জায়গায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে সর্বজনীন গণতন্ত্র। প্রত্যেক জাতিকে নিজেদের জন্য সর্বজনীন গণতন্ত্রের আদর্শ উদ্ভাবন করে নিতে হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে দল-ভিত্তিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দ্বারা সরকার গঠনের পদ্ধতিকে সর্বজনীন গণতন্ত্রে গ্রহণ করা যেতে পারে। তাতে দল বিশেষ গুরুত্ব পাবে। দল আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক সব বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে জনজীবন ও রাষ্ট্রের জন্য পরিকল্পনা ও কর্মসূচী প্রণয়ন ও প্রচার করবে।
এ-কালে প্রায় সর্বত্র প্রত্যেক জাতির মধ্যে মানুষ চলছে ‘ভোগবাদ ও সুবিধাবাদ’ অবলম্বন করে। যারা খেয়ে-পরে চলতে পারছে না, তাদের কথা ভিন্ন। সচ্ছল ও ধনী লোকদের কেন্দ্রীয় প্রবণতা (central motive) অধিক থেকে অধিকতর সম্পত্তির ও ক্ষমতার অধিকারী হওয়া এবং স্থুল ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকা। ভোগ-বিলাসকেই তারা জীবনের অন্তিম লক্ষ্য মনে করে। এই প্রবণতা আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। গত চার দশকের মধ্যে দুনিয়াব্যাপী জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলে গেছে। ধর্ম-প্রবর্তকদের ও দার্শনিক-বৈজ্ঞানিকদের প্রতি মানুষের আগের মতো শ্রদ্ধাবোধ আর নেই। রাজনীতিকদের লোকে ভয় পায়, শ্রদ্ধা করে না। জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদকে বিশ্বায়নের চিন্তা ও কার্যক্রম দিয়ে নস্যাৎ করা হয়েছে। দুর্বল রাষ্ট্রগুলো তাদের রাষ্ট্রসত্তা হারিয়ে চলছে। বাংলাদেশের গত একান্ন বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে দেখা যায়, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কিছুটা গড়ে উঠেছে বটে তবে বাংলাদেশ তার রাষ্ট্রসত্তা হারিয়েও চলছে। ভূভাগ থাকবে, জনসাধারণ থাকবে, সরকার স্বাধীন-রাষ্ট্রের সরকারের মতো থাকবে না, সার্বভৌমত্বও থাকবে না। সরকার অনুগত থাকবে পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার দৈনিক পত্রিকাগুলোতে দ্বৈত নাগরিকত্ব সম্পর্কে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে যাতে বলা হয়েছে বাংলাদেশের কোনো নাগরিক যদি বাইরের ১০১ টি রাষ্ট্রের কোনোটিতে নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন, তাহলে বাংলাদেশে তাঁর নাগরিকত্ব বহাল থাকবে এবং বাংলাদেশে তিনি নাগরিকের সকল অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। সেই সঙ্গে এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভারতের কোনো নাগরিক যদি অন্য রাষ্ট্রে নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন, তাহলে ভারতে তাঁর নাগরিকত্ব ও নাগরিকের সুযোগ-সুবিধা বাতিল হয়ে যায়। পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্রে ভারতের এই বিধির মতো বিধি নিয়ে চলছে। আরো অনেক ঘটনা আছে যেগুলো পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি প্রভৃতি দলের নেতারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের চেয়ে নিজেদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকাকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হয়ে উঠবে কীভাবে? বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা দরকার। শ্রমিক, কৃষক, নিন্মবিত্তেরা তো ঘুমন্ত; বাকিরা সুবিধাবাদী, ভোগবাদী।
দুনিয়াব্যাপী সাধারণ মানুষ এখন মনোবলহারা, নির্জীব, নিষ্ক্রিয়, ঘুমন্ত। তারা পরিশ্রম করছে, নতুন প্রযুক্তি নিয়ে তাদের শ্রমে উৎপাদন ও সম্পদ বেড়েছে এবং বাড়ছে। দুনিয়াব্যাপী সম্পদের প্রাচূর্য দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে অন্যায়-অবিচার, জুলুম-জবরদস্তি ও অসাম্য বেড়েছে, বাড়ছে। যারা উৎপাদন করছে তারা আগের চেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছে, তারা দুর্বল।
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর থেকেই দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গ আধিপত্যবাদী মনোবৃত্তি নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে; অস্ত্র উৎপাদনে, অস্ত্র সংগ্রহে এবং যুদ্ধজোট গঠনে তৎপর থাকছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকা দেখলে বলতে হয়, উৎপাদন ও সম্পদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শাসক শ্রেণীর লোকদের মনোবৃত্তি নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টতর হচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পরেই বসনিয়া, হার্জেগোভিনা, সার্বিয়ায় তিন-চার বছর যুদ্ধ চলেছে। তার পরেই আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ায় যুদ্ধ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ন্যাটো বাহিনীকে মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোতে যুদ্ধে ব্যবহার করেছে। এখন ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো ইউক্রেনকে অস্ত্র, অর্থ, সামরিক ট্রেনিং ইত্যাদি দিয়ে সহায়তা করছে। এই যুদ্ধ বিশ্বযুদ্ধে রূপ নিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইছে না যুদ্ধ থেমে যাক। পৃথিবীর সব রাষ্ট্রই এই যুদ্ধের প্রভাব অনুভব করছে, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। অবিলম্বে যুদ্ধজোট ন্যাটো বিলুপ্ত করার এবং ইউক্রেনে যুদ্ধ থামানোর জন্য দুনিয়াব্যাপী গণআন্দোলন দরকার। আমরা যুদ্ধ চাই না, চাই শান্তি ও প্রগতি। ১৯৪৯ সালে ফিলিস্তিনীদের বাস্তুচ্যূত করে ইহুদি রাষ্ট্র রূপে ইসরাইলকে প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই চলছে ইসরাইলের নানা রকম আগ্রাসী কর্মকাণ্ড ও যুদ্ধ। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে মদদ দিয়েছে, দিচ্ছে।
গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদের চরম দুর্গতির মধ্যে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে পরিত্যক্ত পুরাতন সংস্কার-বিশ্বাস ও ধর্ম। ধর্মের ধারণাকে নানাভাবে বিকৃত করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামের নাম নিয়ে দেখা দিয়েছে তালেবান, আলকায়দা, আইএস, হুজি প্রভৃতি জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ইসলাম তাহলে কী?
মানব প্রজাতির কল্যাণে পৃথিবীব্যাপী চলমান বাস্তবতার পরিবর্তন করতে হবে। রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থা পরিবর্তন ঘটাতে হবে। সর্বজনীন গণতন্ত্রের ধারণা উদ্ভাবন করে পৃথিবীব্যাপী জাতিরাষ্ট্র সমূহকে পুনর্গঠিত করতে হবে। বহুজাতিক রাষ্ট্রগুলোর জন্য প্রয়োজন মতো পুনর্গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জাতিসঙ্ঘকে রাষ্ট্রসঙ্ঘ রূপে পুনর্গঠিত করে কার্যকর ও শক্তিশালী করতে হবে। রাষ্ট্রসঙ্ঘকে হতে হবে জাতিরাষ্ট্র সমূহের ঊর্ধতন একটি সংস্থা, যার কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকবে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে জাতিরাষ্ট্র সমূহের মধ্যে সম্প্রীতির ও সহযোগিতার সম্পর্ক সৃষ্টি করা ও রক্ষা করা, যুদ্ধ ও যুদ্ধের সম্ভাবনা বিলুপ্ত করা ইত্যাদি। শান্তি, সম্প্রীতি ও প্রগতির নীতি নিয়ে চলতে হবে রাষ্ট্রসঙ্ঘ, রাষ্ট্র, জাতি ও পরিবারকে। নারী নির্যাতন কেন হচ্ছে তা বুঝতে হবে এবং নারী-পুরুষ মিলে সমস্যার সমাধানের উপায় বের করতে হবে। দেশে-বিদেশে যাঁরা নানাভাবে পরিবার বিলুপ্ত করে ফেলার জন্য কাজ করছেন, তাঁদের চিন্তা ও কাজ কতখানি বাস্তবসম্মত ও কল্যাণকর? রাষ্ট্রসঙ্ঘের কাছে একটি সেনাবাহিনী রেখে সকল রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করতে হবে। বিবেকবান চিন্তাশীল মনীষীদের কর্তব্য মানব-প্রজাতি ও তার পরিবেশের উন্নতির জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ও কর্মনীতি প্রণয়ন করা ও প্রচার করা। জনগণের সক্রিয়তা ও অংশগ্রহণ ছাড়া কেবল বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সর্বজনীন কল্যাণে বিশেষ কিছু করতে পারবেন না।
এই লেখায় যে-কটি বিষয়ের উল্লেখ করা হল সেগুলো নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা, আলোচনা-সমালোচনা ও বিচার-বিবেচনা দরকার। উন্নত অবস্থা কেবল কামনা করলেই পাওয়া যাবে না, তার জন্য চিন্তা ও কাজ করা লাগবে। সময়ের দাবি অনুযায়ী নতুন ধারার চিন্তা ও কাজ আমাদের এই ঢাকা শহর থেকেও আরম্ভ হতে পারে। এখন এই আরম্ভটাই দরকার।
(আবুল কাসেম ফজলুল হক লেখক, সম্পাদক – লোকায়ত; সাবেক শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)