Homeদক্ষিণ এশিয়াভারতে সাম্প্রদায়িকতা

ভারতে সাম্প্রদায়িকতা

-

শেখ হাসিনার শাসন আমলে নরেন্দ্র মোদির ভারত সরকার বাঙলাদেশকে মনে করতো তার আশ্রিত রাষ্ট্র। তার আগেও ভারত-বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য ছিল না, কিন্তু শেখ হাসিনার আমলে এই সম্পর্কের ভয়াবহ অবনতি ঘটে। নিজেকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে ভারতের সাহায্যের বিনিময়ে শেখ হাসিনা বাঙলাদেশের স্বার্থ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে দাসখত লেখার মত করে তা ভারত সরকারের কাছে বিলিয়ে দেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চরম ঔদ্ধত্বের সাথে ঘোষণা করেন যে, তাঁর সরকারের সাথে বাঙলাদেশের নয়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সম্পর্ক! এই ঘোষণা ও বক্তব্য আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক অদ্ভূত ব্যতিক্রমী ব্যাপার ছিল। আজ পর্যন্ত দুনিয়ার কোন সাম্রাজ্যবাদী দেশকেই এভাবে তার সাথে অধীনতার সম্পর্কে জড়িত দুর্বল কোন রাষ্ট্র সম্পর্কে এ ধরনের কোন প্রকাশ্য ঘোষণা দিতে দেখা যায় নি। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার এবং হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের এই সম্পর্কের কারণে ৫ই অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং শেখ হাসিনা কর্তৃক দেশ ছেড়ে পলায়ন ছিল ভারত সরকারের স্বার্থের ওপর এক বড় রকম আঘাত। এই আঘাত ও ক্ষতি মেনে নেওয়া নরেন্দ্র মোদির ভারত সরকারের পক্ষে সম্ভব না হওয়ায় ৫ই অগাস্টের পর ভারত বাঙলাদেশের ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ এর পরিবর্তে শত্রুরাষ্ট্রে পরিণত হয়। এই শত্রুতার সম্পর্ক কার্যক্ষেত্রে পরিবর্তন না করে এখনো পর্যন্ত তারা বাঙলাদেশের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। এমনকি খোলাখুলিভাবে তারা বাঙলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান বজায় রেখেছে। সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম নিয়মিত ও ব্যাপকভাবে বাঙলাদেশের বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে এখনো তাদের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।

ভারত সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে সেখানকার মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানা সাম্প্রদায়িক নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি মুসলমানদেরকে বহিরাগত হিসাবে তারা ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ ভারতে বেসরকারীভাবে নয়, সরকারীভাবেই সাম্প্রদায়িকতা সরকারী নীতি হিসাবে প্রকাশ্যেই কার্যকর করা হচ্ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার যে, এই ধরনের একটি চরম সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র কোন বাস্তব ভিত্তি ছাড়াই বাঙলাদেশে হিন্দুদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ ও নির্যাতনের কথা বলে তাদের প্রচার মাধ্যমে আকাশ বাতাস উতলা করছে। এটা যে তাদের সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রীয় নীতিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ এতে কোন সন্দেহ নেই।

ভারতে সাম্প্রদায়িকতা কোন নোতুন ব্যাপার নয়। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ব্রিটিশ আমলে সাম্প্রদায়িকতার যাত্রা। হিন্দু মুসলমান উভয় সাম্প্রদায়িকতার সাথে অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকলেও এ দুই ধরনের সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে পার্থক্য আছে। মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার সাথে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত। এ দুই স্বার্থই হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার সাথে জড়িত থাকলেও হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তি হিন্দু সমাজ ও হিন্দু ধর্ম। এখানে বলা দরকার যে, হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব নানা কারণে ব্রিটিশ আমলে হলেও হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা আরও অনেক প্রাচীন। এই সাম্প্রদায়িকতা তাদের বর্ণ প্রথার (Caste System) মধ্যে গ্রোথিত। বর্ণ প্রথার কারণে হিন্দুদের ধর্মীয় কাঠামোর মধ্যেই সাম্প্রদায়িকতা আছে যা হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার থেকেও আরও অনেক কঠিন, কঠোর ও নিষ্ঠুর। চার ভাগে বিভক্ত বর্ণ প্রথার মধ্যে শুদ্র বা নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের কাছে ঘৃণার পাত্র। হিন্দু ধর্মের কাঠামোর মধ্যে থাকলেও নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা উচ্চ বর্ণের কাছে অস্পৃশ্য (Untouchable)। হিন্দু ধর্মের উচ্চ অংশ নিম্ন অংশকে যেভাবে ঘৃণ্য এবং অস্পৃশ্য জ্ঞান করে অন্য কোন ধর্মের মধ্যেই তা দেখা যায় না। বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, ইসলাম, শিখ ধর্মের মধ্যে ভালোবাসার কথা খুব গুরুত্বপূর্ণভাবে থাকলেও হিন্দু ধর্মে ভালোবাসার পরিবর্তে বর্ণপ্রথা অনুযায়ী ঘৃণারই প্রাধান্য। হিন্দু ধর্মের মধ্যে বর্ণপ্রথা সৃষ্ট সাম্প্রদায়িকতা এমনভাবে দেখা যায় যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। প্রত্যেক সামাজিক ক্রিয়াকর্মের মধ্যে এই সাম্প্রদায়িকতা এক নির্ধারক রীতি হিসাবে কাজ করে। এর প্রভাব হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এত গভীর যে, তাঁদের মধ্যে যাঁরা এই প্রথার ঘোর বিরোধী তাঁদের মধ্যেও অবচেতনভাবে এর প্রভাব ও রেশ দেখা যায়। এজন্য যাঁরা হিন্দুধর্ম পরিত্যাগ করে খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন অথবা যাঁরা নাস্তিক তাঁরাও নিজেদের বর্ণ পরিচয় বা বর্ণ পদবী পরিত্যাগ না করে নামের সাথে মুখার্জী, ব্যানার্জী, বোস, দত্ত থেকে নিয়ে দাস, সাহা ইত্যাদি পদ নামের সাথে জুড়ে রাখেন। এটা তাঁদের মনে হয় না যে, বর্ণপ্রথা বিরোধী হলেও বর্ণ নাম ধারণ করে রাখার মাধ্যমে তাঁরা একভাবে বর্ণপ্রথা জীইয়ে রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন।

বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সামাজিক সাম্য ও ভালোবাসার ধর্ম প্রচার করলেও শেষ পর্যন্ত তারা বর্ণপ্রথার অবসান ঘটাতে ব্যর্থ হয়। ভারতে বর্ণপ্রথার পুনরুত্থান ঘটে। ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ডক্টর আম্বেদকর বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে শক্ত লড়াই করেন কিন্তু তিরিশের দশকে এসে তিনি বর্ণপ্রথার প্রতিনিধি গান্ধীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। ভারতে অনেক অর্থনৈতিক উন্নতি এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন সত্ত্বেও বর্ণপ্রথা আজ পর্যন্ত শক্তিশালীভাবে অক্ষুণ্ণ আছে। তার দাপট কিছুটা কমে এলেও বর্ণপ্রথা সৃষ্ট সাম্প্রদায়িকতা হিন্দু সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এদিক দিয়ে হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা থেকে বর্ণপ্রথা ভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা আরও অনেক বেশী প্রতিক্রিয়াশীল ও শক্তিশালী।

হিন্দু ধর্মের এই অবস্থার জন্য ভারতে মুসলমান বিরোধী সাম্প্রদায়িকতা খুব শক্তিশালী। এই সাম্প্রদায়িকতার উপস্থিতি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় পুরোপুরি বজায় থাকলেও অখণ্ড ভারতের আওয়াজ তুলে কংগ্রেস অসাম্প্রদায়িকতার এক মুখোশ ধারণ করে। মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িকতার চরিত্র ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক। কিন্তু অসাম্প্রদায়িকতার মুখোশ ধারণ করা কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িকতা সেই সাথে ছিল সামাজিক ও ধর্মীয়। এজন্য সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের সাথে ধর্মচর্চার কোন সম্পর্ক না থাকলেও গান্ধী ছিলেন হিন্দু ধর্মের প্রচারক ও বর্ণপ্রথার রক্ষক। বর্ণপ্রথার রক্ষক হওয়া সত্ত্বেও ভাঁওতাবাজী করে নিম্ন বর্ণের লোকদের তিনি নোতুন নামকরণ করেছিলেন ‘হরিজন’ বা ঈশ্বরের মানুষ। শুধু নিম্ন বর্ণের হিন্দুদেরকে তিনি কেন ঈশ্বরের মানুষ বলার প্রয়োজন বোধ করলেন তার মধ্যেই তাঁর ভাঁওতাবাজীর পরিচয় পাওয়া যায়।

নরেন্দ্র মোদি ভারতের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর মুহূর্ত থেকেই সে দেশে হিন্দুত্ববাদ প্রচারে অবতীর্ণ হন। হিন্দু ধর্মের রক্ষক এবং পবিত্রতা বজায় রাখার ধ্বজাধারী হিসাবে তিনি প্রথম থেকেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোদগারণ শুরু করেন। তাদেরকে ভারতে অনুপ্রবেশকারী ও নিম্ন শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে আখ্যায়িত করে তিনি যে তোলপাড় প্রচার করেন তার সাথে হিন্দু ধর্মের বর্ণপ্রথা সৃষ্ট বিভক্তি ও সাম্প্রদায়িকতার ওতপ্রোত সম্পর্ক। বর্ণ স্থান থেকে যে মানসিকতা তৈরী হয় সেই মানসিকতার প্রতিফলনই ঘোরতরভাবে তাঁদের মুসলমান বিরোধিতার মধ্যে দেখা যায়। কাজেই নরেন্দ্র মোদির মুসলমান সম্প্রদায় বিরোধিতা শুধু রাজনৈতিক নয়, ধর্মীয় ব্যাপারও বটে। তাঁর এই মুসলমান বিরোধী সাম্প্রদায়িকতা কোন নোতুন ব্যাপার নয়। ২০০২ সালে গুজরাটে প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরই তিনি সেখানে এক ব্যাপক ও নির্মম দাঙ্গা বাধিয়ে হাজার হাজার মুসলমান হত্যা করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে তাঁর সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলমান বিরোধিতার ক্ষেত্র সারা ভারত জুড়ে প্রসারিত হয়। তার বৃত্তান্ত সকলেরই জানা, এখানে বিশদভাবে তার উল্লেখের কোন প্রয়োজন নেই।

নরেন্দ্র মোদির এই ঘৃণ্য মুসলমান বিরোধী সাম্প্রদায়িক চরিত্র সত্ত্বেও শেখ হাসিনা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যেভাবে তাঁর পদলেহন করে এসেছিলেন তার মধ্যে তাঁরও ঘৃণ্য চরিত্রের ও দেশদ্রোহিতার পরিচয় পাওয়া যায়। বাঙলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতে এখন যে ব্যাপক মিথ্যা প্রচারণা দেখা যাচ্ছে তার সাথে পলাতক ও ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বেঈমান শেখ হাসিনাও যুক্ত আছেন। বাঙলাদেশে তাঁর দলের লোকরা তাঁর নির্দেশে একই কাজ করার চেষ্টা করছে। তাদের বুদ্ধিজীবীরাও ঘাপটি মেরে থাকা অবস্থায় পরোক্ষভাবে সেই চেষ্টা করছে। কিন্তু সারা বাঙলাদেশের মানুষ এখন তাদেরকে ঘৃণার চোখে দেখার কারণে ও তাদের যে কোন চেষ্টা প্রতিহত করার জন্য তৈরী থাকায় তারা কোন সুবিধা করতে পারছে না।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই ভারত সরকার এবং ভারতের প্রচার মাধ্যম বাঙলাদেশে হিন্দুদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক আক্রমণের নানা মিথ্যা বিবরণ প্রচার করছে। এমনভাবে তারা এই প্রচার করছে যাতে মনে হয় বাঙলাদেশে মুসলমানদের আক্রমণ থেকে হিন্দুদেরকে রক্ষার একমাত্র শক্তি ছিল আওয়ামী লীগ ও তার নেত্রী শেখ হাসিনা। তাদের উৎখাতের পর বাঙলাদেশের হিন্দুরা এখন মুসলমানদের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। বাঙলাদেশে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির এই ভাষ্য যে শতভাগ মিথ্যা এটা বাস্তব অবস্থার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এটা ঠিক যে, ৫ই অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাঙলাদেশে হিন্দুদের কিছু বাড়ীঘর লুটপাট হয়েছে এবং মন্দির ও মূর্তি ধ্বংসের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু হিন্দুদের বিরুদ্ধে এটা ঘটলেও একে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেওয়া সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ যত হিন্দুর বিরুদ্ধে এই আক্রমণ হয়েছে, যত বাড়ীঘর আক্রান্ত হয়েছে তার থেকে মুসলমানদের বাড়ীঘর আক্রান্ত ও সম্পত্তি লুটপাট হয়েছে অনেক বেশী। যত হিন্দু মন্দির আক্রান্ত হয়েছে তার থেকে অনেক বেশী সংখ্যয় আক্রান্ত হয়েছে মুসলমানদের মাজার ও মসজিদ। হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের লোকদের বিরুদ্ধে এই আক্রমণ চালিয়েছে লুটপাটকারীরা দেশে হঠাৎ শাসন ক্ষেত্রে একটা শূন্যতা সৃষ্টির পরিস্থিতিতে। যারা হিন্দুদের ঘরবাড়ী লুট করেছে ও আগুন দিয়েছে তারা লুটপাটকারী, কোন সাম্প্রদায়িক আক্রমণকারী নয়। বাঙলাদেশে ৫ই অগাস্টের পর যে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তাতে কিছু সংখ্যক হিন্দু আক্রান্ত হলেও তার থেকে অনেক বেশী সংখ্যায় আক্রান্ত হয়েছেন মুসলমানরা। বাঙলাদেশে হিন্দুর সংখ্যা ৮ শতাংশ। লুটপাট শুরু হলে মুসলমানদের সাথে হিন্দুরাও যে আক্রান্ত হবেন সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ হলে সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন সামনে না এলেও হিন্দুদের বিরুদ্ধে যে কোন আক্রমণকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেওয়া সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কিছু নয়। ৮ শতাংশ হওয়ার কারণে দেশে যে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে হিন্দুদের বিরুদ্ধে যে কোন আক্রমণকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেওয়া হবে কেন? তাঁরা কি জনগণের একটা অংশ নন? সারা দেশে লুটপাটকারীরা যে আক্রমণ চালিয়েছিল ৮ শতাংশ লোক হিসাবে হিন্দুরাও তার শিকার হয়েছেন। এর সাথে সাম্প্রদায়িকতার কোন সম্পর্ক নাই। এক্ষেত্রে হিন্দু মুসলমান সকলেই একই কাতারে, তাঁরা লুটপাটকারীদের আক্রমণের শিকার।

এই হলো বাস্তব অবস্থা। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে এর সত্যতা সহজেই চোখে পড়বে। কিন্তু এদিক দিয়ে কোন বিচার বিবেচনা না করে হিন্দুদের বিরুদ্ধে যে কোন আক্রমণকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে ভারত সরকার এবং ভারতের সংবাদ মাধ্যম হৈচৈ করছে, বাঙলাদেশের বিরুদ্ধে তাদের প্রচারণা তুঙ্গে তুলছে। বাঙলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক তিক্ত করছে।

শেখ হাসিনার শাসনকালে ভারত সরকার একচ্ছত্রভাবে বাঙলাদেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখে একতরফাভাবে সব রকম সুবিধা আদায় করেছে। কিন্তু বাঙলাদেশ তিস্তা নদীর পানির অংশ থেকে নিয়ে কোন কিছুই ভারত সরকারের থেকে পায় নি। কারণ শেখ হাসিনার আমলে ভারত ও বাঙলাদেশের সম অবস্থান বলে কিছু ছিল না। বাঙলাদেশ ছিল ভারতের একটা আশ্রিত রাষ্ট্রের মত। ভারতের সাথে তার কোন প্রতিবেশী রাষ্ট্রেরই ভাল সম্পর্ক নেই। পাকিস্তানের তো কোন প্রশ্নই নেই। নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা প্রত্যেকের সাথেই তার সম্পর্ক খারাপ। সে ক্ষেত্রে হাসিনার শাসন আমলে বাঙলাদেশ ছিল ভারতের ‘বন্ধুরাষ্ট্র’, প্রকৃতপক্ষে নিয়ন্ত্রণাধীন রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্র হঠাৎ ৫ই অগাস্ট ভারতের হাতছাড়া হওয়ায় তাদের অবস্থা হয়েছে পাগলের মত। বেড়ালের মুখ থেকে মাছ সরিয়ে নিলে বেড়ালের যে অবস্থা হয় ভারতের অবস্থা তার থেকে খারাপ। এই পরিস্থিতিতে নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর নেতৃত্বে ভারত সরকার বাঙলাদেশের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে প্রথম থেকেই শত্রুতামূলক আচরণ করে আসছে। দুনিয়ার কোন দেশই যখন হাসিনার মত এক ক্রিমিনালকে আশ্রয় দিতে রাজী হয়নি তখন নরেন্দ্র মোদির ভারত সরকার তাঁকে আদর করে আশ্রয় দিয়েছে। এর প্রতিদানে শেখ হাসিনা ভারত সরকারের বাঙলাদেশ বিরোধী সকল তৎপরতার সাথে যুক্ত হয়ে এখন নানা চক্রান্তে লিপ্ত আছেন।

হাসিনা যে বর্তমান বাঙলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করবেন এটা স্বাভাবিক। কিন্তু ভারত সরকার ৫ই অগাস্ট থেকে বাঙলাদেশের বিরুদ্ধে যে শত্রুতামূলক আচরণ করে আসছে এবং এখনো চালিয়ে যাচ্ছে তাকে এক ধরনের রাজনৈতিক মূঢ়তা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। কারণ ভারত ও বাঙলাদেশ নিকটতম প্রতিবেশী দেশ হিসাবে পরস্পরের সাথে হাজারো যোগসূত্রে আবদ্ধ। এই সম্পর্ক স্বাভাবিক না হলে উভয় দেশেরই ক্ষতি। এই সত্য তারা যত শীঘ্র উপলব্ধি করে ততই সেটা শুধু বাঙলাদেশের জন্য নয়, ভারতের জন্যও মঙ্গলজনক।

৪.২.২০২৫

প্রবন্ধটি সংস্কৃতি ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।

বদরুদ্দীন উমর
বদরুদ্দীন উমর
জন্ম ২০ ডিসেম্বর ১৯৩১, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর। পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন, রাজনীতি, ও অর্থনীতি অধ্যয়ন করেন। ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ছেড়ে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যোগ দেন। বর্তমানে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Must Read

Ukraine learn from Afghanistan

আফগানিস্তানের কাছ থেকে ইউক্রেনের যা শেখা দরকার

অর্থনৈতিক উন্নয়নের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো যুদ্ধ। বৈশ্বিক সংঘাত আরো বৃদ্ধি পেলে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতির আশা, এমনকি বেঁচে থাকাটাও পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারে।...