Homeজাতীয়আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী শাসক শ্রেণীর একই বৃন্তে দুই ফুল

আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী শাসক শ্রেণীর একই বৃন্তে দুই ফুল

-

২০১৩ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত বদরুদ্দীন উমরের কলাম

শত শত ব্লগারের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন দুষ্ট ব্লগার ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে নিজেদের ব্লগে কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করায় এদেশের পনেরো কোটি মুসলমানের ঈমান নষ্ট এবং খোদ ইসলাম বিপন্ন হয়েছে, এমন কথা কোন কোন ইসলাম ধর্মাবলম্বী লোক ও সংগঠনের থেকে শোনা যাচ্ছে। তারা এটা নিয়ে এমনই আতংকিত যে, এই মুহূর্তে তারা শুধু এই ব্লগারদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দাবি করছেন তাই নয়, দেশজুড়ে তারা ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার ‘ষড়যন্ত্রে’র বিরুদ্ধে এক ধর্মযুদ্ধের ডাক দিয়েছেন।

এই ধর্মযুদ্ধ বা জেহাদের মূল কলকাঠি জামায়াতে ইসলামী নাড়লেও এর সামনের কাতারে এখন আছে চট্টগ্রামের একটি মাদরাসাকেন্দ্রিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসলামের হেফাজতের দায়িত্ব গ্রহণ করে তারা এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছেন যাতে মনে হতে পারে এ সংগঠনটি দীর্ঘদিনের একটি জাতীয় সংগঠন। হেফাজতে ইসলাম যে ১৩ দফা দাবির ভিত্তিতে নিজেদের ধর্মযুদ্ধ শুরু করেছে, তার মধ্যে একটি হল কাদিয়ানিদের অমুসলমান ঘোষণা করে তাদের সব ধরনের কার্যকলাপ বন্ধ করা। এদের এই দাবি থেকে মনে হয়, কে মুসলমান এবং কে মুসলমান নয়, এর সার্টিফিকেট এখন হেফাজতে ইসলামের থেকে নিতে হবে। এসব থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে, হেফাজতে ইসলাম নামে সংগঠনটি জামায়াতে ইসলামীরই একটি বেনামি শাখা সংগঠন এবং এর তাত্ত্বিক অবস্থান বলতে যা কিছু সেটা জামায়াতে ইসলামীর থেকে অভিন্ন।

কারণ কাদিয়ানিদের ইসলামবিরোধী, অমুসলমান ইত্যাদি বলে তাদের শারীরিকভাবে পর্যন্ত নির্মূল করার কর্মসূচি জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদীই প্রথম উত্থাপিত করেছিলেন। এই উদ্দেশ্যে ১৯৫৩ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে বিশেষত পাঞ্জাবে তিনি কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করে হাজার হাজার নিরীহ কাদিয়ানি হত্যা করে পাকিস্তানের ইতিহাসে গণহত্যার উদ্বোধন করেছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এই অপরাধের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তার বিচার করে তার বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দিয়েছিল, যে শাস্তি পরে গভর্নর জেনারেল গোলাম মহম্মদ মওকুফ করেছিলেন। জামায়াতে ইসলামী ও তার বেনামি শাখা হেফাজতে ইসলামের রাজনৈতিক ঐক্যের ব্যাপারটি খোলাসা করার জন্যই এ বিষয়টির অবতারণা এখানে করতে হল।

জামায়াতে ইসলামী কোন সাম্প্রদায়িক দল নয়। এটা হল এক ইসলামী মৌলবাদী ও ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দল।

এদের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত যেসব তাত্ত্বিক বক্তব্য উত্থাপিত ও কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে এসেছিলেন তার দ্বারাই এটা প্রমাণিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যে ভূমিকা রেখেছিল তার মধ্যেও এর প্রমাণ ছিল। জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলন যখন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী থাকে, তখন তারা নিজেদের এই চরিত্র যথাসাধ্য আড়াল করে রাখে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তি যখন দুর্বল থাকে তখনই এরা মাথা তোলে, নিজেদের মুখোশ ফেলে দিয়ে এরা ফ্যাসিস্ট শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলাদেশে এটাই হয়েছে।

এ প্রশ্ন অবশ্যই করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সময় তো বটেই, তার আগে জামায়াতে ইসলামী এবং নানা ধরনের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কোন গুরুত্ব ও শক্তি না থাকা সত্ত্বেও জামায়াতে ইসলামী কিভাবে ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে বর্তমানে এক দুষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি হিসেবে বাংলাদেশে আবির্ভূত হল? ১৯৭১ সালে এদেশের বিভিন্ন ধারার কমিউনিস্টদের এক অংশ আওয়ামী লীগের পদলেহন করে এবং অন্য অংশ স্বাধীনতা যুদ্ধকে দুই কুকুরের লড়াই বলে আখ্যায়িত করে নিজেদের অপদার্থতা ও দেউলিয়াপনার পরিচয় দিয়ে কমিউনিস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়েছিল। এটা দেশের জনগণের জন্য ছিল এক মহা ক্ষতির ব্যাপার। কারণ কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক তৎপরতার অবর্তমানে একদিকে যেমন ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার বিকাশের শর্ত তৈরি হয়েছিল, তেমনি অন্যদিকে সন্ত্রাসী জাতীয়তাবাদভিত্তিক ফ্যাসিস্ট শক্তি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে খুব সহজেই সংগঠিত হয়েছিল।

লুটতরাজ, চুরি, দুর্নীতি ছাড়াও আওয়ামী লীগের এই ফ্যাসিস্ট চরিত্রের কারণে দেশের জনগণের কোন মূল সমস্যা সমাধান করা তো দূরের কথা, সেসব বিষয়ে চিন্তাভাবনা পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ছিল না। কাজেই ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় জনগণের মধ্যে যে চেতনার সঞ্চার হয়েছিল, যে আশা-আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়েছিল, তা এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ শাসন এবং তার পরবর্তী প্রত্যেক সরকারের আমলেই ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল। এর ফলে জনগণের মনে যে গভীর হতাশা সৃষ্টি হয়েছিল, সেটাই ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার উত্থানের বাস্তব শর্ত তৈরি করেছিল। এ দুনিয়ায় কিছু না পেয়ে, সবকিছু থেকে বঞ্চিত হয়ে ইহলোকের পাওনা পরকালে পাওয়ার আশায় অনেকে ধর্মের দিকে ঝুঁকেছে। এই সুযোগে নানা ধরনের লোক শেখ, মাশায়েখ, আলেম, উলামা ইত্যাদি খেতাব ধারণ করে জনগণকে নিজেদের বলয়ে টেনে আনা ও টেনে রাখার চেষ্টায় নিযুক্ত আছে। এই পরিস্থিতিতে একদিকে বাংলাদেশের জনগণ ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ এবং অন্যদিকে উগ্র জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিবাদের মধ্যে আটকা পড়ে এক কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন।

গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন শক্তিশালী করে ফ্যাসিস্ট শাসক শ্রেণী ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটানা সংগ্রাম পরিচালনাই এই দুরবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য জনগণের একমাত্র পথ। কিন্তু জরুরি হলেও এ আলোচনার বিস্তার ঘটানোর সুযোগ এখানে নেই। নাকের ডগায় এখন যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, তার দিকে তাকালে দেখা যাবে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণী এখন মোটা দাগে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, এর এক অংশ ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী শক্তিকে সামনে নিয়ে আসার জন্য বড় রকম ভূমিকা পালন করছে এবং অন্য অংশ বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকার নিজেই। এদের দুই পক্ষই ফ্যাসিস্ট।

কিন্তু নিজেদের এই ফ্যাসিস্ট চরিত্র আড়াল করার উদ্দেশ্যে এরা জামায়াতে ইসলামী ইত্যাদি ধর্মীয় দলগুলোকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেয় এবং নিজেদের পরিচয় দেয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক হিসেবে। ধর্মীয় দলগুলোকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার এমন সব কাণ্ড করে, যার ফলে ধর্মীয় শক্তিগুলো দুর্বল না হয়ে শক্তিশালী হয়।

উদাহরণ হিসেবে হেফাজতে ইসলামের ৬ এপ্রিলের ‘লংমার্চে’র কর্মসূচির কথা বলা যায়। বাংলাদেশের ১৫ কোটি মুসলমানের ঈমান রক্ষা এবং ইসলামের হেফাজতের দায়িত্ব নিজেদের ঘাড়ে নিয়ে তারা লংমার্চ করে ঢাকায় এসে তৌহিদি জনতার পক্ষে বক্তব্য ও কর্মসূচি প্রদান শান্তিপূর্ণভাবে করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাদের ঘোষণা অনুযায়ী শান্তিপূর্ণ লংমার্চের সুযোগ তাদের না দিয়ে সরকার তাদের তাঁবেদার কিছু সংগঠনকে দিয়ে ৫ তারিখ সন্ধ্যা থেকে ৬ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত হরতাল ঘোষণা এবং লংমার্চওয়ালাদের ঢাকায় আসার পথে বাধা দেয়ার জন্য অবরোধের ব্যবস্থা করেছে। কেন এ কাজ করা হল?

এর দ্বারা কি ইসলাম হেফাজতকারী হিসেবে দাবিদার এই সংগঠন ও তার নেতাকর্মীদের নিজেদের শক্তিবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়তা করা হল না? এ ধরনের কাজ করেই কি আওয়ামী লীগ ও তাদের জোট সরকার ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে রাজনীতির সামনের কাতারে এসে অবস্থান গ্রহণে সহায়তা করেনি? এদিক দিয়ে বিচার করলে এদেশে ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে সংগঠিত হওয়া ও নিজেদের প্রভাব বলয় সম্প্রসারিত করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ কি তাদের ভূমিকা এবং অবদান অস্বীকার করতে পারে? অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মবিযুক্ত (secular) রাজনৈতিক দল হিসেবে দাবিদার আওয়ামী লীগ যে কত বড় প্রতারক সংগঠন এবং তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা ধর্মীয় রাজনীতি প্রতিরোধের নামে যে কর্মকাণ্ড করছে তা কতখানি নির্বোধ ও নিষ্ফল, সেটা ইতিমধ্যেই তাদের নানাবিধ তৎপরতার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে।

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ন্যায়সঙ্গত দাবির ভিত্তিতে যে আন্দোলন প্রাথমিকভাবে ঢাকার শাহবাগ চত্বরে শুরু হয়েছিল, সে আন্দোলনকে বিপথে চালিত করে এখন ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল জামায়াতে ইসলামী এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগ তাদের নিজ নিজ ঘরানার সংগঠন ও ব্যক্তিদের শাসক শ্রেণীর অংশ হিসেবে ব্যবহার করে যে জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে তাতে দেশজুড়ে তারা উভয়পক্ষই যে পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে জোরদার করার খেলাতেই নিযুক্ত আছে এতে সন্দেহ নেই। এদিক দিয়ে শাসক শ্রেণীর এই দুই অংশ আপাতদৃষ্টিতে যতই পরস্পরবিরোধী হোক, শ্রেণীভাই হিসেবে এরা উভয়েই জনগণের সব ধরনের স্বার্থের বিরোধী। এদের উভয়ের রাজনীতিই বাংলাদেশে জনগণের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনীতির বিকাশের ক্ষেত্রে সব থেকে মারাত্মক ও বিপজ্জনক প্রতিবন্ধক।

বদরুদ্দীন উমর
বদরুদ্দীন উমর
জন্ম ২০ ডিসেম্বর ১৯৩১, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর। পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন, রাজনীতি, ও অর্থনীতি অধ্যয়ন করেন। ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ছেড়ে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যোগ দেন। বর্তমানে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Must Read

Partition of India

ভারত ভাগের কথা

ভারতের ইতিহাসের একটা বৈশিষ্ট্য এই যে, হাজার হাজার বছর ধরে বাইরে থেকে বিশাল আকারে বিভিন্ন জাতির লোক যেভাবে ভারতে প্রবেশ করেছে এ রকম অন্য...