পৃথিবীর মানচিত্রে একটা খুবই ছোট দেশ হল বাংলাদেশ। নদী অববাহিকার দেশটা ছোট হলেও জীববৈচিত্র্যে অসাধারণ। ধানের প্রাচীনত্ব, পুষ্টি ও ভেষজ গুন সম্পন্ন ধানের স্থানীয় জাতের অভূতপূর্ব সমারোহ বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করেছে। পঙ্খীরাজ, গোবিন্দভোগ, জামাইভোগ, মোগাই বালাম, রূপকথা, রাঁধুনী পাগল, পাঙ্গাস, ঝিঙ্গেসাইল, শিলকমর এসব নাম শুনলে তা বোঝা যায়। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বয়স্ক কৃষকরা শুধু মনে করতে পারেন লক্ষ্মীজটা, রানী সেলুট, ঝুমুর, বালাম, হিজলদীঘি, রাজা মোড়ল সহ আরও অনেক চমকপ্রদ নাম। সেগুলোর অস্তিত্ব এখন আর নেই।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (ব্রি BRRI) জানাচ্ছে, অন্ততঃ ১০ হাজার এ রকম দেশী ধানের জাত এখন বিলুপ্ত প্রায়। কোন কোনটা আবার একদমই হারিয়ে গেছে। গত শতাব্দীতে প্রায় ১৮ হাজার জাতের দেশী ধানের তথ্য পাওয়া যায়। এখন প্রায় ৮,৬০০ জাত ব্রি-তে সংরক্ষিত আছে। যা দিয়ে নিত্য নতুন ধানের জাত উদ্ভাবনের কাজ চলছে। তথ্য থেকে জানা যায় পাহাড় থেকে সমতল ভূমির আউশ, আমন, বোরো ধানের সব মিলিয়ে ৩ হাজারের বেশী জাতের ধান চাষ হচ্ছে। ব্রি-র ২০১১ সালের জরীপে জানা যায়, বাংলাদেশে কম বেশী ৮ হাজার জাতের ধান চাষ হচ্ছে। তবে এসব বীজের সরাসরি দেশী ধানের জাত নাই বললেই চলে।
বেসরকারী প্রতিষ্ঠান উবিনীগ ‘নয়া কৃষি আন্দোলন’ নামে এক কৃষি ভিত্তিক কর্মসূচী চালাচ্ছে, যা দেশীয় কৃষি পণ্যকে জনপ্রিয় করার কাজ করে চলেছে। তাদের মতে এ দেশে এক সময় ১৫ হাজার দেশী জাতের ধান চাষ করা হত। স্থানীয় কিছু ধানের জাতের নাম সংস্থাটি তাদের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করেছে। এগুলো হল রায়েদা, লক্ষ্মীবিলাস, হনুমানজটা, নোনাকুচি, পাকড়ী, ঝিংগাশাইল, লালঢেপা, যশোয়া, তিলকাবুর, চিনিসাগর, সোনামুখী, কালোমেখী, সূর্যমুখী, খেজুর ঝুপি, কলসকাটি, দুলাভোগ, পোড়াবিন্নি, শিলগুড়ি, কাটারীভোগ, দাদখানি, রাধুনীপাগল, মাইষদল, মাটিচাক, বটেশ্বর, ফুলবাফাল, ফুলমালা, বাঁশফুল, কটকতারা, সরিষাফুলি, মধুশাইল, বাইলাম, ঘিগজ, রাজাশাইল, মধুমালতী, যাত্রামুকুট, বাবইঝাঁক, জলকুমারী, গান্ধীভোগ, লেবুশাইল, ফুলমুক্তা, বেনামুড়ি, পাটজাগ, কালামানিক, হারিঙ্গাদীঘা।
দেশী জাতের ধানের ফলন কিছুটা কম হলেও পুষ্টি ও ভেষজ মান সমৃদ্ধ ছিল। সার, কীটনাশক, সেচ, অন্তরবর্তীকালীন পরিচর্যা লাগতো না।
দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে খাদ্য চাহিদা মিটাতে কম ফলনের দেশী জাতের ধানের গুরুত্ব কমছে। তাই নতুন জাত উদ্ভাবনের তাগিদ আসে তৎকালীন পাকিস্তান আমল থেকেই। আইয়ুব খানের আমলে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (ইরি) থেকে ধানের জাত আমদানী করা হয়। পর্যায়ক্রমে ব্রি ইরি-র যৌথ গবেষণায় উচ্চ উৎপাদনের ধানের জাত উদ্ভাবনে ব্রতী হয়। এখন গুরুত্ব পাচ্ছে আবহাওয়া, প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলা করে অল্প সময়ে বেশী ফলন দেওয়া জাতের চাহিদা। তাই হাইব্রিড ও উচ্চ ফলনশীল ধানের জাতের প্রাধান্য বেড়েই চলেছে।
এখন জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়কে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে,
১। ফলন বাড়াতে হবে – আগের জাতের চেয়ে ফলন বাড়াতে হবে;
২। সময় কম লাগতে হবে – কম সময়ে বেশী ফলন পেতে হবে;
৩। স্ট্রেস অর্থাৎ খরা, বন্যা, লবণাক্ততা, উষ্ণতা, তাপ সহ্য করা ছাড়াও রোগ বালাই এবং পোকামাকড় মোকাবেলা করে যে জাতগুলো বেশী ফলন দিবে;
৪। কোয়ালিটি বা মানসম্পন্ন হতে হবে – প্রিমিয়াম কোয়ালিটি।
আউশ, আমন, বোরো মৌসুমে কয়েকটা জাত বিশেষ কারণে এখন বেশী জনপ্রিয়। যেমন, আমন মৌসুমে ব্রি ধান-৮৭, যেটা রোপা আমন হিসাবে পরিচিত। এর বৈশিষ্ট্য হল সাদা রংয়ের লম্বা ও চিকন চাল। এটা সব চেয়ে উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত বা চারা রোপনের ১২৭ দিনের মতো সময়ে কাটা যায়। এছাড়া, খরা সহিষ্ণু রোপা আমন (ব্রি-৭১) চাল হয় লম্বা, মোটা সাদা রংয়ের এবং অলবণাক্ত জোয়ার ভাটা সহিষ্ণু রোপা আমন (ব্রি-৭৬) জাতের ধান বেশ জনপ্রিয়। বোরো মৌসুমে জনপ্রিয় উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত ব্রি-২৬ ও ২৯। চাল মাঝারী চিকন ও সাদা। এখন জনপ্রিয় হয়েছে ব্রি-৯৬ উফশী বোরো ধান যার চাল মাঝারী ধরনের খাটো ও সোনালী রং এর। আগের জাতের চেয়ে এই জাতে একই সময়ে হেক্টর প্রতি ফলন প্রায় দেড় থেকে দুই টন বেশী।
আউশের মধ্যে উফশী ব্রি-৪৮ বেশী আবাদ হচ্ছে। যার চাল মাঝারী মোটা ভাত ঝরঝরে হয়। এখন জিংক, প্রোটিন ও ডায়াবেটিক সহ নানা বৈশিষ্ট্যের ধানের জাত ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট ছাড়পত্র দিয়েছে।
জিংক সমৃদ্ধ বোরো জাত ব্রিধান-৮৪ চালের পেরিকার্পের রং লালচে, চালের আকার মাঝারী চিকন আর রং সাদা। এতে জিংক এবং মধ্যম মাত্রার আয়রন ও প্রোটিন আছে। ব্রি এ পর্যন্ত ৫টি জিংক সমৃদ্ধ ধান জাতের অনুমোদন দিয়েছে।
১৯৭০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (ব্রি) মোট ১০৫টি জাতের ধান উন্মুক্ত করেছে যার মধ্যে ৭টি জাত হাইব্রিড (Hybrid) যেগুলো আউশ, আমন, বোরো মৌসুমে চাষের জন্য অনুমোদিত। এই উন্নত উচ্চ ফলনশীল জাতগুলো প্রতিকূল ও অপ্রতিকূল পরিবেশ উপযোগী। এর মধ্যে আছে,
- ৪৩টি জাত বোরো ও আউশ
- ২৫টি জাত বোনা ও রোপা আউশের জন্য
- ৪৫টি রোপা আমন চাষের উপযোগী
- ১২টি বোরো ও আউশের উপযোগী
- ১টি জাত বোরো, আউশ ও রোপা আমনের উপযোগী
- ১টি বোনা আউশের জন্য অনুমোদিত।
আগে আমরা বলেছি দেশী জাতের ধান হারিয়ে যাওয়ার কথা। তবে এই আগ্রাসনের মাঝেও বহু ব্যক্তি ও বেসরকারী সংস্থা নাটোর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, যশোর, মানিকগঞ্জ, বরিশাল সহ বেশ কিছু জেলায় দেশী জাতের ধানকে ফিরিয়ে আনার ও প্রসারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। রাজশাহীর জনাব মাহবুব সিদ্দিকী তাঁর লেখা মূল্যবান গ্রন্থ হারিয়ে যাওয়া সোনার ধান-এ দেশীয় ধানের ইতিহাস, গবেষণা নিয়ে সার্বিকভাবে আলোচনা করেছেন।
চিলমারীর দেশী জাত ‘গঞ্জিয়া’ ধানকে উবিনীগ ফিরিয়ে এনেছে। এর বৈশিষ্ট্য হল, তাড়াতাড়ি ঘরে উঠে, সার, কীটনাশক লাগে না, নিড়ানীর প্রয়োজন পড়ে না, ব্রহ্মপুত্র নদের পলিতেই সারের কাজ হয়ে যায়। ফলন নেহায়েত কম নয়। হেক্টর প্রতি ফলন ৩২১১ কেজি এবং খড় হয় ৮৬৩৩ কেজি। চাল চিকন। বাজার দর বেশ ভালো।
দেশী জাতের ধানের মধ্যে উচ্চফলনশীল (উফশী) জাত সমূহের হেক্টর প্রতি ফলন গড়ে ৩ টন। এ রকম দেশী ধানের উচ্চফলনশীল জাতের খবর আছে যার হেক্টর প্রতি উৎপাদন ৪-৫ টন। হাইব্রিড জাতের উৎপাদন হেক্টর প্রতি ৮ টন ধরলে বাছাই করা দেশী জাতের ধানের উৎপাদন কোনো অংশে কম না। উৎপাদন খরচ অর্থাৎ সেচ, সার, কীটনাশক, অন্তরবর্তীকালীন পরিচর্যা দেশী ধানে বলতে গেলে লাগেই না। সে হিসাবে উফশী ধানের খরচ বেশী বলা যায়। কীটনাশক, সার ব্যবহারে মাটির ও পরিবেশের সমূহ ক্ষতি পরিলক্ষিত হয়। কৃষক পর্যায়ে ব্যাপক রাসায়নিক ব্যবহার ও অপরিকল্পিত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনে পানির স্তর নেমে যাওয়া সহ পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। নদ-নদী, পুকুর, বিল হাওরে মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। মৌমাছি, পাখী সহ বিভিন্ন উপকারী পোকা মাকড় (predator) কৃষি রাসায়নিকে ধ্বংস হচ্ছে। উফশী ধান চাষে সেচ, সার, কীটনাশক অপরিহার্য অথচ দেশী ধানে এসবের প্রয়োজন পড়ে না। একদিকে কৃষকের উৎপাদন খরচ কম এবং পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক থাকে। পাশাপাশি খাদ্য পুষ্টি নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে দেশী জাতের পুষ্টি ও ভেষজ গুণ সম্পন্ন ধান মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অবদান রাখতে সক্ষম হত।
দেশে যতগুলি ধানের জাত চাষ হচ্ছে তার মধ্যে একটি বড় অংশ এখন হাইব্রিড ধানের দখলে। বাকীটা ইনব্রেড (Inbred) ধানের জাতের অধীন। আজ একদিকে দেশী জাতের ধানকে নিশ্চিহ্ন করতে উফশী নামের জাত দাপট চলছে। পাশাপাশি হাইব্রিড জাত বিরাট এলাকা দখল করেছে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের (বিনা) ১৭টা ধানের জাত বর্তমানে মাঠে আছে। অবশ্য বিনা কোন হাইব্রিড ধানের জাতের ছাড়পত্র দেয়নি। বিনা কর্তৃক ছাড় করা জাতের মধ্যে খরা সহিষ্ণু, বন্যা সহিষ্ণু, সুগন্ধযুক্ত, স্বল্প মেয়াদী ও অসংবেদনশীল জাত, জিংক সমৃদ্ধ জাত, লবণ সহিষ্ণু ও আগাম জাত রয়েছে। ফলন গড়ে হেক্টর প্রতি ৪-৭ টন।
গবেষণা ক্ষেত্রে দেশী জাতের ধানের উপরে প্রকৃতপক্ষে তেমন কোন কাজই হয়নি। দেশী জাতের মধ্যে থেকে উচ্চ ফলন সমৃদ্ধ জাতগুলি নির্বাচন করে গবেষণা করা যেতো এবং দেশী জাতের ফলন বৃদ্ধির চেষ্টা নেওয়া যেতো। অথচ তা না করে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট থেকে ইরি ধান আমদানী করা হয়েছিল। কৃষি গবেষণায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান সমূহ নিজস্ব স্বকীয়তা বিবেচনায় নিয়ে গবেষণা কাজকে এগিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু প্রথমেই উচ্চ ফলনশীল জাতের মোহ তথা প্রকৃতপক্ষে হাইব্রিড জাতের ব্যাপক প্রসার বাংলাদেশের কৃষককে বীজহীনতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আগে ছোট বড় সকল কৃষকের বাড়ীতে ধান সহ অন্যান্য ফসলের বীজ থাকতো। আজ যা চোখে পড়ে না। কৃষক এখন বাজার থেকে বীজ ক্রয় করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
একবার কি আমরা চিন্তা করেছি কি ভয়াবহভাবে কৃষকের হাতের বীজকে ব্যবসায়ী পুঁজিবাদীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া বিচিত্র জাতের ধান সমূহ মানব স্বাস্থ্যের জন্য ছিল অত্যন্ত হিতকর।
আমরা সেই সম্পদকে সরিয়ে নিয়ে ইরিসহ বহুজাতিক কোম্পানীদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে চলেছি। শুধু ধানই নয়, বরং তরমুজ, মরিচ, চিচিংগা, পটল, পালংশাক, টমেটো, শশা, লাউ, করল্লা ইত্যাদি সবজী ফসলের চাষ এখন হাইব্রিড বীজের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
দেশী বিদেশী কোম্পানী সমূহ এখন হাইব্রিড বীজের বিরাট ব্যবসাদার। বলা হচ্ছে হাইব্রিড চাষের বাস্তবতা এখন অপরিসীম। বাংলাদেশের কৃষকের ঘরে বীজ থাকা কৃষকের অধিকার। সেই অধিকার থেকে আমরা কৃষককে বঞ্চিত করে চলেছি। বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ সবকিছুই কৃষককে এখন ক্রয় করতে হচ্ছে। অথচ একদিন ছিল কৃষককে এসব উপকরণ কিনে চাষ করতে হতো না। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অধিক খাদ্য ফলানোর দোহাই দিয়ে আজ আমরা কৃষককে ভয়ঙ্কর বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছি। একদা স্বয়ংসম্পূর্ণ কৃষক এখন চরম অনিশ্চয়তার দিকে চলেছে।
আজ আমাদের অঙ্গীকার হোক কৃষককে বীজ ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলা যাতে করে কৃষকের অধিকার সংরক্ষিত হয়।
(আবুল আশরাফ কৃষিবিদ, গবেষক)