আধুনিক মানববিদ্যা স্বীকার করে নিয়েছে যে, বাঙালি এমন এক জাতি যার অনেক গুণ আছে এবং সঙ্গে সঙ্গে দুর্বলতাও। তার অনিয়ন্ত্রিত আবেগ বহু ক্ষেত্রেই সর্বনাশ ঘটিয়েছে। এর বৈজ্ঞানিক উৎসের সন্ধান অবশ্যই জটিল। কেননা মানব জীবন এবং সমাজ বহুস্বর আর বহুস্তরীয়। মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে যে জটিল বিজ্ঞান চর্চা এর উত্তর ওখানেই অনুসন্ধান চলে। আমরা এর বাইরে এসে জাতি হিসেবে বাঙালির আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তার বিবর্তন নিয়ে আলোকপাত করতে চাই। হাজার বছরের অনড় সমাজে আচমকা ধাক্কা দেয় ইউরোপীয় আধুনিক সভ্যতা বা রেনেসাঁ। সেই রেনেসাঁ এবং উপনিবেশবাদ সঙ্গত কারণেই চরম দ্বন্দ্ব তৈরি করে পৌরাণিক হিন্দু ধর্মে এবং তার সংস্কৃতিতে। এর ফল স্বরূপ বহু ঈশ্বর আর অসংখ্য দেব-দেবীতে আকীর্ণ পৌত্তলিক হিন্দু ধর্ম বিরোধী একেশ্বরবাদী নিরাকার ব্রাহ্ম দর্শন বা ধর্মের উদ্ভব ঘটে। অভিঘাতটি তৈরি হয় ইসলাম এবং খ্রিস্ট ধর্মের প্রভাবে। থিথিস আর এন্টিথিথিস হিসেবে জন্ম নেন রামকৃষ্ণ এবং বিবেকানন্দ। ১৯ শতকের বাংলায় তৎকালের রাজধানী কলকাতা হয়ে ওঠে ধর্ম আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি। এটাই ছিল পৌরাণিক হিন্দু ধর্মের আত্মরক্ষার একটি চেষ্টা। এর বিকল্প ছিল না ধর্মটিকে রক্ষার। প্রয়োজন ছিল রিফর্মের। এভাবেই উদ্ভব ঘটে নতুন ডিসকোর্স। একেশ্বরবাদ। ব্রাহ্মধর্মের ব্রাহ্মবাদ।
নগর এবং অভিজাততন্ত্রের বাইরে পড়েছিল বাংলার বৃহত্তর লোকায়ত সমাজ আর জীবন। গ্রাম, হত দরিদ্রের গ্রাম। অশিক্ষার আর কুসংস্কারের অন্য এক দুনিয়া। গ্রামের বাইরে বিশাল যে পৃথিবী আর তার মানুষ, সে সংবাদ কারও জানার কথা নয়। ভূত-প্রেত, মৃত্যু, ব্যাধি, আতঙ্ক, অরণ্যের অন্ধকার, ক্ষুধা, পূর্ণকুটির আর রাজার লোক নিয়ে গড়া বাঙালির পৃথিবী। কলকাতার রেনেসাঁ, ধর্ম আন্দোলন, কে তার সংবাদ রাখে? আউল-বাউল-তান্ত্রিক অবধূত (শৈব সন্ন্যাসী) আর অন্ধকার রাতের ভীতিকর লোক বিশ্বাসের শাসন ঘিরে ছিল প্রতিটি লোকালয়। জীবিতদের চেয়ে মৃতদের শ্মশান-গোরস্তান ও মানুষকে বশীভূত করে রাখতো। অভিজাত বাঙালির রেনেসাঁ, বঙ্গভঙ্গ, দেশ ভাগ, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা আচমকাই গ্রাম সমাজে, ক্ষুধার্তদের ঘরে হামলে পড়লে ওরা জানলো ‘অপদেবতা’ এসে গেছে। ওরা রাষ্ট্র বশ্য, ধর্ম বশ্য, ঈশ্বর বশ্য পতঙ্গ-মানব। অভিজাত তন্ত্র তাদের দান করেছে স্বাধীনতা, স্বাধীন দেশ, গণতন্ত্র, ভোটের রাজনীতি, সংবিধান আরও কত কি। না, ফেরায় নি, দান তারা গ্রহণ করেছে, ক্ষুধা হোক, দারিদ্র্য হোক, ভিক্ষে হোক, অনুদান হোক। ভেবেছে সবই ‘মহান ঈশ্বরের দয়া’। দান গ্রহণের এই অভ্যাস কবে যে বদলাবে কে জানে? এই যে বাঙালি ওরা সমাজ বদলায় না, চিন্তা বদলায় না। যতদিন তারা নিজেদের ভেতরে বদলটা অর্জন না করছে ততদিন ‘ঐশ্বরিক শাসন’ তাদের শাসাবেই। এই হেজিমনি বা আধিপত্য, বিহ্বলতা, কুয়াশাচ্ছন্নতা বড় জটিল।
উপনিবেশিক শক্তির হাত ধরে বাঙালি হিন্দু সমাজে যে নব্য ইংরেজি জানা অভিজাত শ্রেণীর উদ্ভব ঘটলো, সঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর, বিলম্ব হলেও মুসলমান সমাজেও ইংরেজি জানা শ্রেণীটির উদয় হয়। ওয়াহাবী, ফরাইজি আন্দোলনের পথ ধরে মুসলিম সমাজেও রিফর্মের বা সংস্কারের প্রয়োজন পড়ে। বাঙালি হিন্দু হোক চাই কি মুসলমানই হোক, এই সংস্কারকে তারা শ্রেণী হিসেবে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। গ্রাম-শহরের দরিদ্র শ্রেণীকে তারা বার বার ব্যবহার করেছে। রাজনৈতিক আন্দোলনে, স্বাধীনতা যুদ্ধে, গণ ভোটে, জাতীয় নির্বাচনে এই গণ ব্যবহার অতীতে হয়েছে, বর্তমানে হচ্ছে।
আমরা ফিরে দেখতে চাই পূর্ববঙ্গের বাঙালি বা বাঙালদের। ইতিহাস প্রমাণ করে চিরকালই পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা ছিল প্রান্তবাসী বা প্রান্তিক বাঙালি। প্রাচীন ঋকবেদে এই বাঙাল-বাঙালিদের সম্পর্কে ভয়ংকর বিদ্রুপ আর ঘৃণার ছড়াছড়ি। ব্রাহ্মণ্য আর্য্য ধর্ম তাই পূর্ববঙ্গকে ব্রাত্যভূমি হিসেবে বিবেচনা করে সে ধর্ম প্রচারেও ছিল অনীহা। বাঙাল হিন্দু বাঙালী মাটি বা ভূমির ভেতরই তাদের আত্মদর্শন অনুসন্ধান করে গেছে। পশ্চিম বঙ্গের বাঙালির তুলনায় পূর্ববঙ্গের বাঙালি হিন্দু সমাজের কাছে ভূমির দেবত্ব প্রাপ্তি অধিক। ভূমি দেবতা, শস্যদেবীর আড়ালে জড়িয়ে আছে অসংখ্য কল্পিত দেব-দেবী। মুসলিম সমাজেও যে পীরেরা কিংবা পীরের থান দেখা যায় তা সবই ভূমি থেকে উদ্ভূত। ভূমির সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে যে সব পশু তারা হিন্দু সমাজে দেবত্ব লাভ করে আর মুসলমান সমাজে তৈরি হয় বাৎসল্যবোধের ভিন্ন এক দুনিয়া। শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্প এর সাহিত্যিক দৃষ্টান্ত। আজও গ্রাম বাংলায় মানুষ আর পশুর একই ঘরে রাত্রিযাপনের দৃষ্টান্ত মেলে। বাঙালির পশুর প্রতি এই যে ভালোবাসা তা আসলে শস্যভূমির প্রতি মুগ্ধতারই প্রতিকল্প।
কট্টর ব্রাহ্মণ্য ধর্মবাদ আর ইসলামিক ধর্মবাদ ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান ঘটায় বাংলায়, বাঙালি মননে। এটাও ঠিক নয় যে বাঙালি সমাজে ঔপনিবেশিক শক্তি সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপণ করে। এই ধর্ম বিভাজন আর সাম্প্রদায়িকতা মোঘল-পাঠান যুগেও ছিল। তাছাড়া হিন্দু বর্ণবাদ অনেকটা ধর্মবাদের বিকল্প হিসেবে সাম্প্রদায়িকতাকে লালন করে গেছে দীর্ঘ সময়। প্রসঙ্গ টানা অন্যায্য হবে না বর্তমান পশ্চিম বঙ্গকে। চৌত্রিমা বছর একটানা পুঁজিবাদী রাজনীতির অধীনে বাম শক্তি শাসক হিসেবে নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শকে রক্তশূন্য করে দেয়। তাদের পতনের পর তৃণমূলীয় রাজনীতি রাজ্যটিকে দুর্নীতি, চুরি-চামারীর স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। ধর্মীয় রাজনীতিতে ওরা কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। চৌত্রিশ বছর বামেরা পশ্চিম বঙ্গের বাঙালিকে গণতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী বানানো তো দূরের কথা ‘মানুষ’ই বানাতে পারেনি। বাংলাদেশের শাসকেরা কি করছে নিশ্চয়ই জনগণ টের পাচ্ছে। এই হচ্ছে প্রায় ২৬/২৭ কোটি বাংলাভাষীদের চরিত মানস।
পূর্ব বা পশ্চিম বঙ্গের জনগণের সিংহভাগই প্রান্তিক। এই প্রান্তিকজনের ইতিহাস অর্থাৎ সাব অল্টার্ন হিস্ট্রি লেখা খুবই জরুরী। কিন্তু কাজটি খুবই কঠিন। কেননা এই জনগোষ্ঠী চায় ক্ষুধা মুক্তি, অবশ্যই শোষণ মুক্তি। আশ্চর্য এই, ওরাই প্রচণ্ড ভয় পায় সমাজতন্ত্রকে। ওদের রক্ত হিম হয়ে যায় যখন শুনতে পায় ভূমি হারাবার কথা অর্থাৎ ব্যক্তিগত মাটি-জমিন। রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’ কাহিনী কবিতার উপেন জমিদারের হাতে ভূমি হারিয়ে বিপ্লবী হয় না, বরং হয়ে যায় সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসী। সর্বত্যাগী হয়েও পরিণামে মাটির স্মৃতি তাকে টেনে আনে হারানো জন্ম ভিটায়। এই হচ্ছে বাঙালি চরিত্র। সে কিনা ‘দু’পাতা ইংরেজি শিখে’ নগরবাসী হয়। কিন্তু গ্রামে ফেলে আসা শরিকী ভাগ-বাটোয়ারায় পাওয়া আধ কি এক বিঘে জমি বক্ষের ধনের মতো আকড়ে রাখে। বাঙালি যত সাহিত্য লিখেছে তার সিংহভাগই গ্রাম, মাটি, প্রকৃতি। জীবনানন্দকে অমরত্ব দিয়েছে অন্য কোন কাব্য নয়, ‘রূপসী বাংলা’। অস্বীকার করিনা বাঙালি কৃষক আন্দোলন করেছে, জীবন দিয়েছে, জাতির জন্য গৌরব অর্জন করেছে ত্যাগের মহিমায়। কিন্তু আন্দোলনরতদের কারো না কারো মনে কি এমনটা ছিল না যে, এক মুঠো ভূমির ব্যক্তি মালিকানা? এ বড় নিষ্ঠুর আত্ম জিজ্ঞাসা!
সম্প্রতি গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক এক আলোচনা চক্রে বলেছেন, ‘দীর্ঘ সময় ব্যাপী মুসলমান বিদ্বেষ তাদের (ভারতীয় হিন্দু) মননশীলতাকে ভোঁতা করেছে।’ ভয়ংকর সত্য কথা। বর্তমান ভারতবর্ষের শাসক শ্রেণীর প্রতি দৃষ্টি ফেলেই কথাটা বলেছেন গায়ত্রী। আমরা অন্যান্য ভাষাভাষীদের বাদ দিয়ে বাঙালিদের নিয়েই ভাবি না কেন। এই যে আধুনিক বাঙালিরা কেউ কেউ অকল্পনীয় ধনের মালিক হচ্ছে, টাকা-পয়সা আছে বলে বিদেশেও যাচ্ছে উচ্চ শিক্ষার নামে ডিগ্রী ক্রয় করতে, কিন্তু মননশীলতা কোথায়? যত চর্চা হয় ধর্ম-সম্প্রদায় নিয়ে, জ্ঞান নিয়ে হয় কি? হিন্দু সমাজের জাত-পাত-বর্ণের কি মীমাংসা হলো? ‘জাতে-অজাতে-কুজাতে’ বিয়ে-শাদি হয়, কিন্তু জাতের জায়গায় জাতটা টিকে থাকে। বাঙালি যতই আধুনিক হোক, প্রগতিশীল হোক, যখন ঝগড়া-বিবাদ হয় তখন জাত-ধর্ম নিয়ে গালাগালটা মনের ভেতরের দৈত্য হয়ে কলসি ছেড়ে বেরিয়ে পড়বেই। এ যে রক্ত বাহিত-জিন বাহিত। আমার শৈশব স্মৃতি আজও মগজে টিকে আছে। বাড়ির পাশের রাস্তা ধরে লাশ বয়ে নিচ্ছে শীতলক্ষ্যায় দাহ করার জন্য অন্য গাঁয়ের শবযাত্রী। ‘বল হরি, হরি বল’ ধ্বনিতে আমার মা-কাকী মায়েরা পথের দিকে তাকিয়ে মুখে আঁচল টেনে পরস্পর বলাবলি করতেন, ‘মরাটা কোন জাতের ক্যাডা জানে’। তাই বলা যায় বাঙালির অনেক কিছু বদলালেও জাত-পাত-ধর্ম বুঝি অক্ষর অবিনাশী! মনে হবে ওখানেই তাদের আশ্রয়। বাইরে সমাজবদ্ধ হলেও ভেতরে পরস্পর বিচ্ছিন্ন জাত-ধর্মে।
গর্ডন হাডসন, মাইকেল বুসেরি সহ বেলজিয়ামের সেন্ট ইউনিভার্সিটির মোট ছয়জন গবেষক-অধ্যাপক মানুষের (ছাত্রদের) বুদ্ধি বা আইকিউ নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁরা প্রমাণ পেয়েছেন যাদের আইকিউ কম তারা দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী। অন্য দিকে আবেগাঙ্ক (ইমোশনাল) কম থাকলে ও দক্ষিণ পন্থায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। তারা শিক্ষায় অনাগ্রহী। জানার ইচ্ছাও কম। তারা নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে অক্ষম। তারা বদরাগী, ভীরু। কিন্তু প্রতিশোধ নিতে তৈরি। উগ্র ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাসী বলেই তাদের ধারণা অন্যধর্মের লোকেরা সব কিছু দখল করবে। এতে তারা কান্ডজ্ঞান হারায়। এমন ছাত্ররাই দক্ষিণপন্থী রাজনীতির অস্ত্র হয়ে ওঠে। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ইত্যাদি রাষ্ট্রগুলো বর্তমানে এধরনের শিক্ষার ভিতর দিয়েই মানুষের মনে অন্যধর্মের কল্পিত আতঙ্ক সৃষ্টি করে মৌলবাদকে শক্তিশালী করছে। বেঁচে থাকা নয় বরং শহীদ বা আত্মবলিদান করার অন্ধকার এক জগৎ তৈরি করছে ধনতন্ত্রী রাষ্ট্র-সমাজ। এমনি বাস্তবতায় শুভবুদ্ধির বাঙালি মাত্রই আতঙ্কিত। আশ্চর্য এটাই যে, ৩৪ বৎসর বাম শাসিত পশ্চিম বঙ্গে তরুণ প্রজন্মকে এ পথেই বিজেপি আর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) আজ বিভ্রান্ত করছে। কল্পিত ইসলাম ভীতির নামে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চার দুয়ার খুলছে একটি একটি করে। তৃণমূল কংগ্রেস আর বিজেপি এ পথেই অথচ আলাদা কৌশলে সমাজে বিভাজন তৈরিতে মত্ত। হাতে হাত ধরে একদল সেজেছে মুসলিম দরদি, অন্য দল হিন্দু দরদি। উভয়েরই স্বার্থ এক, কিন্তু রাজনৈতিক কৌশল ভিন্ন।
একাত্তরের যুদ্ধকালে বাঙালি ‘বীর পুরুষেরা’ তথাকথিত ‘অচলা নারীদের’ গৃহবন্দী করেছিল সতীত্ব রক্ষার অছিলায়। যুদ্ধ চিরকালই নারীকে টার্গেট করে। কিন্তু ইতিহাস তো প্রমাণ দেয় প্রতিরোধ যুদ্ধে নারীদের অসীম সাহসের কথা। বাঙালিরা আজও নারীকে তার ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দেয়নি। বরং চলমান সময়ে বঙ্গ নারীরা কেবল শারীরিকভাবেই বন্দি নয়, মানসিকভাবেও। বাঙালি সমাজে এমন দৃষ্টান্ত বিরল নয় যে আপন পরিবারই নারীকে অর্থনৈতিক পণ্যে পরিণত করছে। কেনো করছে? করছে এ কারণেই যে ‘বীর পুরুষ’ পুঁজিবাদী লোভ-লালসার ব্ল্যাক ম্যাজিকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। আশ্চর্য এটাও, প্রাচীন বা মধ্যযুগের যে ভারতবর্ষকে রাজা বিক্রমাদিত্যের ‘হিন্দু ভারতের সুবর্ণ যুগ’ বলা হয় সেখানে ঐতিহাসিক নয় বরং পৌরাণিক মহাকাব্য ‘মহাভারতের’ স্বাধীনচেতা নারীরাও হারিয়ে যায়। মানব সমাজে নারীর হারিয়ে যাওয়া বা অস্বীকৃতি তো নতুন নয়, যেনো তা চির বহমান। বাঙালি তো সেই মানব সভ্যতারই অংশ।
আধুনিক বিশ্ব সভ্যতা শিক্ষার নামে বাঙালিকে এক গোলকধাঁধাঁয় ফেলেছে। ইংরেজি মিডিয়াম শিক্ষা, বাংলা মিডিয়াম শিক্ষা আর আরবী বা মাদ্রাসা শিক্ষার ত্রিস্তরীয় চাপে ওরা দিশাহারা। পরিণামে প্রকৃত শিক্ষাটা আর হচ্ছে না। নোবেল জয়ী পদার্থ বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান বলেছেন, ‘ইফ ইউ ওয়ান্ট টু মাস্টার সামথিং, টিচ ইট’। আসলে ছাত্রদের সঙ্গে অব্যাহত জ্ঞান আদান প্রদানের ভিতর দিয়েই শিক্ষক স্মরণীয় হয়ে থাকেন। কোনো বিষয়ের নাম জানাটা তো ‘তথ্য’ জানা, মোটেই ‘জ্ঞান’ নয়। জ্ঞান হচ্ছে তথ্যকে ব্যাখ্যা করা। বাঙালির শিক্ষাটা আসলে কম শ্রমে কম সময়ে কেবল মাত্র ‘তথ্যকে’ জানা। তাই তো বাজারে এত নোট বই, পথে-ঘাটে-ঘরে এত প্রাইভেট টিউটরের ভিড়। শিক্ষার নামে শর্ট-কাট শিক্ষা, খাতা ভর্তি নাম্বার। তাই বাঙালিরা গবেষক কিংবা উদ্ভাবক হতে ব্যর্থ হয়। উদ্দেশ্য কেবল ‘ভাল’ রেজাল্ট। তাই তো বাংলার ঘরে ঘরে আজ এত ইঞ্জিনিয়ার আর চিকিৎসক। খুঁজে পাওয়া যায় না প্রকৌশল বিজ্ঞানী কিংবা ঔষধ আবিষ্কারক।
বাঙালিকে গিলে খেয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার দানব। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার। প্রযুক্তির কি মহিমা! এই প্রযুক্তি দখল নিয়েছে বাঙালির মনোজগৎ, আবেগ, ইচ্ছা শক্তি, প্রেম-ভালোবাসার নামে শরীরী ক্ষুধা। সব কিছুই ভার্চুয়াল, প্রযুক্তির দখলে। বাঙালিকে ঘিরে ধরেছে ভয়ংকর অবসাদ। তা থেকে মুক্তির জন্য বাঙালি প্রযুক্তির দাসে পরিণত হয়েছে। মানসিক ভালোবাসার পরাভব ঘটেছে শরীরী ভালোবাসার হাতে। ওখানে ন্যায় বোধ নেই, লজ্জা-ঘৃণা-ভয় কোনোটাই নেই। ক্রমাগত চলে কেবল ভয়ংকর আত্মখনন আর আত্মহনন।
ভালোবাসা বা প্রেমের কী বীভৎস রূপান্তর ঘটে গেছে। প্রযুক্তিগত বুদ্ধি-উদ্ভাবন ক্ষমতা প্রচণ্ড বৃদ্ধির ফলে মহা বিপর্যয়ে পতিত হয়েছে মানসিক প্রেম-ভালোবাসা। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে ভালোবাসা, সম্পর্ক ভাঙছে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে আকছার। বুঝি ভালোবাসার কাছে মানুষের আর অফুরন্ত প্রাপ্তি নেই। নেই আদি বিশ্বাসের ঐশ্বরিক, অতীন্ত্রিয় মায়া-জাল। তাই তো পুরাতনী বা সনাতনী বাংলা আর বাঙালিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। না নগরে, না গ্রামে। তাই প্রশ্ন ওঠছে আজকের এই যে বাঙালি ওরা কারা? কি চায় ওরা? ওরা যতটা গড়তে জানে তার অধিক জানে ভেঙে লণ্ডভণ্ড করতে। নিজের দেশকেই ওরা একবার, দু’বার, বার বার ভেঙেছে। এবার ভাঙছে নিজেকে, নিজের সত্তাকে। নিজেই নিজের ঘর ভাঙছে, পরিবার ভাঙছে। নিজেকে বিচ্ছিন্ন করছে আপন জন্ম মাটি থেকে। নিজের থেকে নিজেকেই বিচ্ছিন্ন করছে, নিজের মন তো ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। এরই নাম ধনতন্ত্র।
এমন যে বাঙালি তার স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস লিখিত হয়েছে হাজার হাজার কাগজের পৃষ্ঠা খরচ করে। লিখিত হয়েছে কি যুদ্ধকালে তার স্বপ্ন-আতঙ্ক-দ্বিধা-দ্বন্দ্বের গোপন মনের কথা? একাত্তরের পর অর্ধশত বৎসর অতীতে বিলীন হয়ে গেছে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আর অবরুদ্ধ দেশে মৃত্যু-গণহত্যার ভয়ে জলা-জঙ্গলে পলাতক মানুষ কিংবা সীমান্ত পেরিয়ে আর ফিরে না আসা মানুষের অনেকেই আজ মৃত। শরণার্থী শিবিরে ক্ষুধা আর কলেরায় যারা প্রাণ দিয়েছে তারা কি মরণের ওপার থেকে ফিরে আসবে গবেষককে আপন মনের কথা জানাতে? তারপরও অনেকেই বেঁচে আছেন যুদ্ধ স্মৃতি নিয়ে। হয়তো অনেক স্মৃতিই হারিয়ে গেছে সময়ের অভিঘাতে। আসল কথা হচ্ছে কল্পনা করে যুদ্ধসাহিত্য লেখা যায়, ইতিহাস নয়। ইতিহাসের জন্য সাক্ষ্য লাগে, অকাট্ট প্রমাণ লাগে। তারপরও কাজটা অসম্ভব নয়। খুঁজে নিতে হবে আজও বেঁচে থাকা সমাজের নানা স্তরের, নানা অনুভবের মানুষকে। শিক্ষিত, অশিক্ষিত, নারী, পুরুষ, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুভবের মানুষেরা আছেন। তাদের সবার অনুভবের জগৎ এক নয়। অতীত যত দীর্ঘ হোক, প্রতিটি মানুষের মনে আজও কিছু না কিছু মনের অনুভব, আতঙ্কের ছবি, আশা আর বেঁচে থাকার তীব্র বাসনার রেখাচিত্র মগজের কোষে ফসিল হয়ে টিকে আছে। সেই মনটাকে খুঁজে পেতে হবে গবেষকের। নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে দ্বৈত চেতনার একাত্তরের কোনো না কোনো মানুষকে। চেতনার এক পাশে স্বাধীনতার স্পৃহা, অন্যপ্রান্তে মৃত্যু আর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতার প্রতি ঘৃণা। মানুষের মনোলোক তো জটিল এক দুনিয়া, তাকে খুঁজে পেতে শ্রম-মেধা তো লাগবেই। তাছাড়া দেশের ভেতর নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে বেঁচে থাকা হানাদারদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার মানসিক ভারসাম্যহারা কোনো না কোনো নারীকে। তার অসংলগ্ন প্রলাপের ভেতরও একটি অন্ধকারে ঢাকা ক্ষত-বিক্ষত মনের সন্ধান মিলতে পারে। একাত্তরের বাঙালির মনের সেই ইতিহাস লেখা না হলে যুদ্ধ আখ্যানের ইতিহাস যে অর্ধসত্যের ইতিহাস হয়েই থাকবে।
বাংলা ও বাঙালিকে খুঁজে দেখার পরিভ্রমণে বেরিয়ে একটি আশঙ্কা মনে জাগে। বাংলাদেশে চলমান ত্রিস্তরীয় যে শিক্ষা ব্যবস্থা তা একটা সময় বিষময় হয়ে ওঠবে না তো? বাংলা, ইংরেজি আর আরবী মিডিয়াম স্পষ্টতই তিনটি শ্রেণী তৈরি করছে। অর্থনৈতিক আর সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে শ্রেণী বিভাজনের এই ত্রিস্তর শিক্ষার পরস্পর সম্পর্ক দ্বন্দ্বময়। আরবী মাধ্যমে শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণীটি কর্মক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। অন্যদিকে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা অভিজাততন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক। জীবন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটি এগিয়ে আছে। শিক্ষার্থীদের জীবনযাত্রার মান উচুঁতে অবস্থান করে। উচ্চতর শিক্ষা বা বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে এর সুযোগ অধিক। ইউরোপকে অনুকরণ করতে গিয়ে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা বৃহত্তর সমাজ চেতনা থেকে স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এভাবে সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে তারা অভিনতুন এক জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটাচ্ছে। স্বদেশি চেতনাস্নাত যদি হয় বাংলা মাধ্যমের ছাত্ররা, ইংরেজি মাধ্যমেরা হতে চায় পশ্চিমী ঘেষা। আর আরবী মাধ্যমেরা হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্যপন্থী, ধর্মীয় মৌল চেতনার প্রতি গভীর বিশ্বাসে। এই শ্রেণী চেতনার সাংস্কৃতির বিরোধ ভবিষ্যতে বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছতে পারে। এর ফলে সাংস্কৃতিক সংঘাত তৈরি হয়ে রাষ্ট্রকে সংকটে টেনে যে নেবে না এই গ্যারান্টি কে দেবে? শিক্ষা বিভাজন তাইতো বাঙালির অভিশাপ।
১৩.৩.২০২৩
(হরিপদ দত্ত কথাসাহিত্যিক, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক)