Homeজাতীয়ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা প্রসঙ্গে

ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা প্রসঙ্গে

-

প্রত্যেক বছর ফ্রেব্রুয়ারী মাসে এবং অন্য সময়েও শেখ হাসিনা প্রায়ই বলে থাকেন যে, ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের ভূমিকাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয় নি।

২০শে ফেব্রুয়ারী রাজধানীর ওসমানী মিলনায়তনে ‘একুশে পদক ২০২৩’ প্রদান অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর যে অবদান, সেই অবদানটুকু কিন্তু মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। অনেক বিজ্ঞজন, আমি কারও নাম বলতে চাই না, চিনি তো সবাইকে। অনেকে বলেছেন, ওনার আবার কি অবদান ছিল? উনি তো জেলেই ছিলেন। বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন বলে ওনার কোন অবদান নেই? তাহলে উনি জেলে ছিলেন কেন? এই ভাষা আন্দোলন করতে গিয়েই তো তিনি বার বার কারাগারে গিয়েছেন। সেই গুরুত্ব কিন্তু কেউ দিতে চায় নি। আমাদের ভাষা মাতৃভাষার অধিকার আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন সর্ব কালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁরই উদ্যোগে ভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয় ১৯৪৮ সাল থেকে। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা অর্জন।’ পাকিস্তান ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের রিপোর্টে ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের অবদানের কথা উল্লেখ আছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ইনটেলিজেন্স রিপোর্টগুলো পাওয়ার পর আমি একটা ভাষণ দিয়েছিলাম। তখন একজন বিদগ্ধ জন আমাকে খুব ক্রিটিসাইজ করে একটা লেখা লিখলেন যে আমি নাকি সব বানিয়ে বানিয়ে বলছি।’

ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের অবদান মুছে ফেলার ‘অপচেষ্টা’ যে আমি করেছি এটা শেখ হাসিনা কখনো আমার নাম উল্লেখ করে এবং কখনো বা নাম উল্লেখ না করে (যেমন ওপরের উদ্ধৃতি) সুস্পষ্ট ইঙ্গিতে বলে থাকেন। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলে রাখা দরকার যে, আমি আমার লেখায় কোন ক্ষেত্রেই কোন দল বা ব্যক্তিকে বড় বা ছোট করার চেষ্টা কখনো করি নি। আমি সব সময় তথ্যের ভিত্তিতেই লিখেছি, তথ্যের বাইরে কোন আন্দাজী কথাবার্তা বলার অভ্যাস আমার একেবারেই নেই। এদেশের এবং দেশের বাইরেও আমার পাঠকরা এটা ভাল করেই জানেন। নিজের কাছে সৎ থাকাকে আমি গুরুত্ব দিই। কারণ সেটাই হলো, একজনের সৎ চিন্তা ও আচরণের অপরিহার্য শর্ত। এই আত্মমর্যাদা বোধের অভাবই বর্তমানে বাঙলাদেশের মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী, লেখক সাহিত্যিকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে দেখা যায়।

শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ভাষা আন্দোলন করতে গিয়েই তো তিনি বার বার কারাগারে গিয়েছেন।’ এ কথা ঠিক নয়। শেখ মুজিব একবারই, ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ ভাষা আন্দোলনের সময় জেলে গিয়েছিলেন। শুধু তিনি নয়। সে সময় মহম্মদ তোয়াহা, রনেশ দাশগুপ্তসহ অনেকেই জেলে গিয়েছিলেন। চার পাঁচ দিন পরই তাঁদের সকলকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৫২ সালে শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলনের জন্য জেলে ছিলেন না। তিনি শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, এ দেশে অনেক আন্দোলনের সাথেই জড়িত ছিলেন। ১৯৪৯ সালে খাদ্য আন্দোলনের সময় তাঁর জেল হয়েছিল। জেল থেকে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন ১৯৫২ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারী। এর পরও তিনি নানা আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে বার বার জেলে গিয়েছিলেন।

শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমাদের ভাষা মাতৃভাষার অধিকার আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন সর্ব কালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁরই উদ্যোগে ভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয় ১৯৪৮ সাল থেকে।’ এই বক্তব্য ঠিক নয়। পরবর্তী জীবনে শেখ মুজিবুর রহমান একজন বড় মাপের রাজনীতিবিদ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, কিন্তু ১৯৪৮ সালে ঢাকার রাজনীতিতে তাঁর এমন কোন অবদান ছিল না যাতে তিনি ভাষা আন্দোলন বা অন্য কোন আন্দোলনের সূচনা করতে পারেন।

এটা সকলেই জানেন এবং এ সত্য সুপ্রতিষ্ঠিত যে, ১৯৪৮ সালে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন আবদুল মতিন। এজন্য তিনি ‘ভাষা মতিন’ নামে পরিচিত হয়েছিলেন। আবদুল মতিনের সাথে সেই কমিটি গঠনের ব্যাপারে অন্যরাও যুক্ত ছিলেন। কিন্তু তাতে শেখ মুজিবের কোন উদ্যোগ, এমনকি উল্লেখযোগ্য সম্পৃক্ততা ছিল না। অন্য অনেকের মত তিনি ১১ই মার্চ মিছিলে রাস্তায় ছিলেন এবং জেলে গিয়েছিলেন। ১৯৫২ সালে যখন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয় তখন শেখ মুজিব জেলে ছিলেন।

শেখ হাসিনা বলেছেন, পাকিস্তান ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের রিপোর্টে ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের উল্লেখ আছে। শেখ মুজিবকে শাস্তিযোগ্য লোক প্রমাণ করার জন্যও এভাবে লেখা হয়ে থাকতে পারে। এছাড়া গোয়েন্দা পুলিশরা অনেক মিথ্যা রিপোর্ট নিজেরাও তৈরী করে থাকে। মোনায়েম খানের আমলে একবার কুমিল্লার ধীরেণ দত্ত, অজিত গুহ এবং আমাকে জড়িয়ে এক গোয়েন্দা রিপোর্ট দিয়েছিল। এটা নিয়ে মোনায়েম খান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শামসুল হক সাহেবের ওপর আমাকে বরখাস্ত করার জন্য চাপ দিয়েছিলেন। তাতে কাজ হয়নি। এর পরই ঐ গোয়েন্দা রিপোর্ট মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ গোয়েন্দাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় মণি সিং এর বিরুদ্ধেও এক মিথ্যা গোয়েন্দা রিপোর্ট দেওয়া হয়েছিল এবং সেটাও ধরা পড়েছিল।

কিন্তু এক্ষেত্রে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রাখা যায় তা হলো, ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ইতিহাসবিদদের সংগৃহীত তথ্যের পরিবর্তে গোয়েন্দা পুলিশের রিপোর্টই কি অধিকতর নির্ভরযোগ্য? ইতিহাসবিদদের পরিবর্তে পুলিশের গোয়েন্দারাই কি প্রকৃত অর্থে সত্যের ধারক বাহক?

ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের ভূমিকা মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে এটা শেখ হাসিনার নিজস্ব বক্তব্য। বাস্তবতঃ দেখা যাবে ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের নায়কোচিত ভূমিকার কথা বলে এদেশে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। অজস্রই বলা যেতে পারে। এই ধরনের একটি লেখার কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। কারণ এটি প্রকাশিত হয়েছে কয়েকদিন আগে, ২১শে ফেব্রুয়ারী দৈনিক বাংলা পত্রিকায়। বাংলা একাডেমী এবং আওয়ামী ঘরাণার এক সাহিত্যিক ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষা আন্দোলন’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। এই প্রবন্ধে শেখ মুজিবুর রহমানকে ভাষা আন্দোলনের মহানায়ক হিসেবে উপস্থিত করে অনেক কথা বলা হয়েছে, কিন্তু জনগণের ভূমিকার কোন উল্লেখ মাত্র এই লেখায় নেই! বলা হয়েছে ভাষা আন্দোলন ছিল শেখ মুজিবের আন্দোলন! বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ। বাস্তবতঃ শেখ মুজিবের ভূমিকা কোথায় কিভাবে ছিল এর কোন উল্লেখ না করে তিনি বলেছেন ভাষা আন্দোলন যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে তাতে তাঁর ‘নেপথ্য ভূমিকার অবদান’ এর কথা। এই রচনায় ইতিহাসকে যেভাবে বুড়ো আঙুল দেখানো হয়েছে তা বিস্ময়কর। এভাবে ইতিহাসকে বুড়ো আঙুল দেখাতে তিনি বলছেন, “তিনি না হলে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ভূখণ্ড অর্জন কত শতাব্দী পিছিয়ে যেত তা পরিমাপ করা যায় না।” দেখা যাচ্ছে পূর্ব বাঙলায় জনগণের ওপর পাকিস্তান সরকারের শোষণ নির্যাতন, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ জনগণের ওপর পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সর্বাত্মক সশস্ত্র আক্রমণ, তার বিরুদ্ধে জনগণের বিশাল স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ আন্দোলন, তাঁদের আত্মত্যাগ, এ সবের কোনই গুরুত্ব নেই বাঙলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ক্ষেত্রে! শেখ মুজিব না থাকলে জনগণের সেই প্রতিরোধ ‘শতাব্দীর পর শতাব্দী’ বাঙলাদেশকে স্বাধীন করতে পারতো না! এই ধরনের লেখালেখি ও ভুল ইতিহাস চর্চাই এখন বাঙলাদেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবী, লেখক, ইতিহাসবিদ, সাহিত্যিকরা করছেন। এর ফলে বিভিন্ন পদ অধিকার করে এবং নানা প্রকার সুযোগ সুবিধা লাভ করে তাঁরা ভালই আছেন।

পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি বইটি লেখার সময় ১৯৬৯ সালের প্রথম দিকে শেখ মুজিবুর রহমানের একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। (এই সাক্ষাৎকারের বিবরণ আছে আমার আত্মজীবনী আমার জীবন এর তৃতীয় খণ্ডে)। একদিন তাঁকে ফোন করে বললাম, আমি ভাষা আন্দোলনসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে একটা বই লিখছি, তাঁর একটা সাক্ষাৎকার নিতে চাই। তিনি বললেন, আগামীকাল সকাল সাতটায় চলে এসো। আমি যথা সময়ে গেলাম ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে তাঁর বাড়ীতে। সেই একবারই আমি ঐ বাড়ীতে গেছি। গিয়ে দেখলাম সেই সাত সকালেই সেখানে লোকের ভীড়। আমি খবর দেওয়ায় তিনি বেরিয়ে এসে আমাকে তাঁর সাথে ভেতর দিকের একটা কামরায় নিয়ে গেলেন। কাজের লোকদেরকে বললেন, কেউ যেন ঘরের মধ্যে না আসে। এর পর তিনি নিজেই দরজা বন্ধ করে দিলেন।

আমি তাঁর সাথে ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ধর্মঘট আন্দোলন, ১৯৪৯ সালের সালের খাদ্য আন্দোলন, ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনসহ পরবর্তী কালের রাজনীতি ও রাজনৈতিক আন্দোলন নিয়ে অনেকক্ষণ আলাপ করেছিলাম। তিনি তো আমাকে ছোট বেলা থেকেই চিনতেন। আগ্রহের সাথে আমাকে অনেক সময় দিয়েছিলেন। কথাবার্তার মধ্যে আমাকে রসগোল্লাও খাইয়েছিলেন।

১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের বিষয় আলোচনার সময় তিনি বললেন সেই আন্দোলনে তাঁর বড় ভূমিকা ছিল। আমি বললাম, সেটা কি করে হয়। আপনি তো তার আগে কলকাতায় ছাত্র লীগের রাজনীতি করেছিলেন। ঢাকার সাথে তাঁর কোন সম্পর্ক তো থাকে নি। সে সময় ঢাকায় নবাগত ছিলেন। তিনি বললেন, ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ও জেলে যাওয়ার কথা। আমি বললাম, সে সময় তো শত শত ছাত্র এবং সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী রাস্তার আন্দোলনে ছিলেন। তাঁদের অনেকেরই জেল হয়েছিল। তাঁদের সকলের একটা ভূমিকা থাকলেও অল্প সংখ্যকেরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

এছাড়া আমি তাঁকে বললাম আপনি তো বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সদস্যও ছিলেন না। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের ঠিক পরপরই জিন্নাহ্ সাহেব ঢাকা এসেছিলেন। তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সাথে এবং ছাত্র লীগের নেতৃস্থানীয়দের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। মহম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, শামসুল হক, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সহ অনেকে সেই দুই সাক্ষাতের সময় ছিলেন কিন্তু আপনি তো তাঁদের মধ্যে ছিলেন না। তিনি বললেন, আমি তাজউদ্দীন ও নজরুল ইসলামকে আমার প্রতিনিধি হিসাবে পাঠিয়েছিলাম। কায়েদে আজম এর সাথে নিজে দেখা করতে না গিয়ে প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন এ কথায় আমি খুব বিস্মিত হয়েছিলাম। তাঁকে বললাম, সেটা কি করে হয়। এখন আপনি তাঁদেরকে আপনার প্রতিনিধি হিসাবে কোথাও পাঠাতে পারেন। কিন্তু তখন ঢাকার রাজনীতিতে তো তাজউদ্দীন ও নজরুল ইসলামের গুরুত্ব আপনার থেকে বেশী ছিল। সৈয়দ নজরুল ইসলাম তো ছিলেন সলিমুল্লাহ্ মুসলিম হলের ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি)। সেই হিসাবে তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সদস্য ছিলেন। তাজউদ্দীন ছিলেন একটি গ্রুপের সদস্য এবং তখনকার ঢাকার রাজনীতিতে সুপ্রতিষ্ঠিত একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। তিনি এরপর আর কিছু বললেন না, চুপ করে থাকলেন। আমার এসব কথার পর তিনি যে আমার ওপর রাগ করেছিলেন বা বিরক্ত হয়েছিলেন, এমন মনে হলো না।

ভাষা আন্দোলন বিষয়ে আমার লেখার বিরুদ্ধে লেখালেখি ও বিষোদ্গার শুরু হয়েছিল অনেক আগে। এর সূচনা করেছিলেন অধ্যাপক মাযহারুল ইসলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সহকর্মী, পরে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। দৈনিক ইত্তেফাক এ ১৯৭৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী বিশেষ সংখ্যা ও পরবর্তী রবিবাসরীয় একাধিক সংখ্যায় একাডেমীর তৎকালীন মহাপরিচালক মাযহারুল ইসলাম ‘ভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিব’ শীর্ষক একটি দীর্ঘ রচনা প্রকাশ করেন। এ রচনাটিতে তাঁর বক্তব্য ছিল, আমি ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের ভূমিকাকে অস্বীকার করে কৌশলের সাথে তাঁকে খাটো করার চেষ্টা করেছি। বস্তুতঃপক্ষে তাঁর রচনাটির সাথে তথ্য ও সত্যের কোন সম্পর্ক ছিল না। সেটা ছিল তোষামোদের উদ্দেশে আমার বিরুদ্ধে এক বড় মিথ্যাচার। সে সময় তিনি বাঙলা একাডেমীর মহা পরিচালক।

আমি মাযহারুল ইসলামের সেই রচনাটির একটি দীর্ঘ জবাব দিয়ে ইত্তেফাক পত্রিকায় পাঠালাম। দুই কিস্তিতে সেটা ছাপা হয়েছিল। এখানে বলা দরকার যে, ইত্তেফাকে ডক্টর মাযহারুল ইসলাম আমার বিরুদ্ধে যা লিখেছিলেন সে সব কথা ছিল তাঁর দ্বারা লিখিত ও বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ নামে একটি বৃহদাকার বইয়ে। বইটি ছিল মিথ্যায় পরিপূর্ণ। মাযহারুল ইসলাম তাঁর লেখাটিতে এমন এক কাণ্ড করেছিলেন যা ছিল বিস্ময়কর। বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক, বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক, পরবর্তী কালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদাধিকারী একজন লোক যে কতখানি মূর্খ, অসৎ ও ধান্দাবাজ হতে পারে তার দৃষ্টান্ত তিনি রেখেছিলেন। তিনি নাটকীয়ভাবে বর্ণনা করেছিলেন ভাষা আন্দোলনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এর ভূমিকার কথা। লিয়াকত আলীর মৃত্যু হয়েছিল ১৯৫১ সালের ১৬ই অক্টোবর। এ নিয়ে তখন চারিদিকে মহা হৈচৈ হয়েছিল।

মাযহারুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়ে চলে যাওয়ার পর বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক হয়েছিলেন মুস্তফা নূরুল ইসলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরা বাংলা বিভাগে সহকর্মী থাকার সময় তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছিল না।

বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক হওয়ার পর মুস্তফা নূরুল ইসলাম একদিন শেখ মুজিবের সাথে একাডেমীর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য তাঁর সাথে দেখা করেন। তখন রাত প্রায় বারোটা। অন্যান্য বিষয় আলোচনার পর তিনি শেখ মুজিবকে বলেন তাঁকে নিয়ে কিছু লেখালেখি হচ্ছে যা অনাকাঙ্খিত। এ সবের দ্বারা তাঁর ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী শুধু নয়, জাতির পিতা। কাজেই তাঁর ভাবমূর্তি এভাবে নষ্ট হওয়া ঠিক নয়। মুস্তফা সাহেব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরোক্ষভাবে এসব কথা বলতে থাকার সময় শেখ মুজিব তাঁকে বলেন, কি বলছিস সোজা করেই বল না। এত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলার কি দরকার? শেখ মুজিবের এ কথার পর মুস্তফা সাহেব আমার বিরুদ্ধে মাযহারুল ইসলামের লেখালেখির কথা, বিশেষ করে তাঁর ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ নামক বইটির কথা উল্লেখ করেন। এ কথা শুনে শেখ মুজিব তাঁকে বলেন, তুই কি মনে করিস আমি এসব বিষয়ে কিছু জানি না। এই বলে তিনি বইয়ের একটি শেল্ফ দেখিয়ে বলেন, ওটার ওপর যে ফাইলটা আছে সেটা নিয়ে আয়। ফাইল নিয়ে এলে তিনি বললেন, দেখ ওতে কি আছে। দেখা গেল, সেই ফাইলে আমার ও ডক্টর মাযহারুল ইসলামের ইত্তেফাকে প্রকাশিত বিতর্কমূলক রচনাগুলি এক সাথে সাজিয়ে রাখা আছে। খুব সম্ভবতঃ প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে ফাইলটি তৈরী করে তাঁর কাছে দেওয়া হয়েছিল।

ফাইলে লেখাগুলি দেখে মুস্তফা সাহেব বলেন, আপনি তো এগুলি দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মত কি? শেখ মুজিব বললেন, উমর যা লিখেছে তার তথ্যগুলি ঠিক, সে বিষয়ে আমার বলার কিছু নেই। তবে তার মূল্যায়নের সাথে আমি একমত নই। মুস্তফা সাহেব বললেন, ডক্টর মাযহারুল ইসলামের বই যদি ভুল তথ্যে এভাবে ভরা থাকে তাহলে সেটা তো আপনার ভাবমূর্তি নষ্ট করবে। আপনি তো দেশের প্রধানমন্ত্রী ও জাতির পিতা। কিন্তু আপনি যদি বলেন তাহলে বইটির যে হাজার হাজার কপি গুদামে আছে সেগুলি আমি স্কুল কলেজে ও বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানে বিক্রী করে দিতে পারি। তবে সেটা তো ভালো হবে না। কিন্তু যদি এভাবে বিক্রী করা না হয় তাহলে আবার বাংলা একাডেমীর বিরাট ক্ষতি।

মুস্তফা সাহেব এ কথা বলার পর শেখ সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, ‘যা বইগুলো ফেলে দেগা। কোন অসুবিধা হবে না। ওপরে আল্লাহ্ নীচে শেখ মুজিব।’ এর পর দিন সকালের দিকে বাংলা একাডেমীতে গিয়ে মুস্তফা নূরুল ইসলাম ডক্টর মাযহারুল ইসলামের নধরকান্তি বইটির হাজার হাজার কপি গুদাম থেকে বের করে ফেলে দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ আছে পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত আমার আত্মজীবনীর (প্রকাশক বাঙ্গালা গবেষণা) চতুর্থ খণ্ডে। হাজার হোক, নিজের একটা বৃহদাকার জীবনীগ্রন্থ এভাবে ফেলে দেওয়ার মধ্যে যে শেখ মুজিবের সততার একটা পরিচয় ছিল এতে সন্দেহ নেই।

ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের ভূমিকা মুছে ফেলা তো দূরের কথা ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিবের রাজনৈতিক ভূমিকা সম্পর্কে আমি বাঙলাদেশের অভ্যুদয় নামক আমার দুই খণ্ডে প্রকাশিত (প্রকাশক বাতিঘর) বইয়ে আমি অনেক লিখেছি। একশো ভাগ তথ্যের ভিত্তিতে লিখিত বিবরণে তাঁর ভূমিকা যাই হোক না কেন তা মুছে ফেলার কোন চেষ্টা আমি করিনি।

ইতিহাসে যে কোন ব্যক্তির ভূমিকা আলোচনার জন্য ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। কারণ কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তির ভূমিকা সম্পর্কে কে কি মনে করে তার দ্বারা কোন ব্যক্তির সঠিক ভূমিকা নির্ণয় করা একেবারেই অবৈজ্ঞানিক এবং প্রকৃত ইতিহাস চর্চার পথে মস্ত অন্তরায়। এ কথা সত্য যে, একজন বড় মাপের ঐতিহাসিক ব্যক্তি তাঁর নিজের বিশেষ ক্ষেত্রে সমাজকে, সমাজের চিন্তাভাবনা, সাহিত্য কর্ম, বিজ্ঞান চর্চা, রাজনীতি ইত্যাদিকে অল্প বিস্তর প্রভাবিত করে থাকেন। কিন্তু তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, তাঁদের প্রত্যেকেই নিজের সময়ের সমাজ কাঠামোর অধীনস্ত। প্রত্যেক মানুষের, তিনি যতই সামান্য বা বিরাট হোন, চিন্তাভাবনা ও কার্যকলাপ তাঁর পরিপার্শ্ব এবং তাঁর সময়কার সমাজ সম্পর্ক ও বিদ্যমান পরিস্থিতি দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় আঠারো শতকের সমাজে সম্ভব ছিলেন না। ডারউইন ও মার্কসও সম্ভব ছিলেন না আঠারো শতকে। উনিশ শতকে সম্ভব ছিল না গান্ধী, জিন্নাহ্, নেহরুর মত রাজনৈতিক নেতার আবির্ভাব। আইনস্টাইনের মত বিজ্ঞানী সম্ভব ছিলেন না উনিশ শতকে। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকের মত চিত্র পরিচালক সম্ভব ছিলেন না বিশ শতকের প্রথম দিকেও। শুধু তাই নয়, এই সব বিরাট পুরুষ ছাড়াও সাধারণ রাম রহিমের জীবনও এভাবে তাঁদের বিদ্যমান সমাজ দ্বারাই গঠিত। যে কোন মানুষের, তিনি ছোট বড় মাঝারী যে মাপেরই হোন, জীবন, চিন্তাভাবনা ও কর্ম তাঁর সময় ও সমাজ দ্বারা নির্ধারিত। কাজেই কে কার সম্পর্কে কি মনে করছে বা মনে করতে চায় তার দ্বারা কোন ব্যক্তির ঐতিহাসিক ভূমিকা নির্ধারণ প্রচেষ্টা বিবেচনার বিষয় হতে পারে না। ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা নিয়ে মার্কস, প্লেখানভ ও লেনিনের তাত্ত্বিক রচনা আছে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্য কারও কারও মত আমিও ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা বিষয়ে লিখেছি।

ইতিহাসে দেখা যায় যাঁরা নিজের বিশেষ ক্ষেত্রে বড় মাপের মানুষ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন, ভূমিকা পালন করেছেন, সেটা রাতারাতি হয়নি। প্রত্যেকের মানই ছোট থেকে বড় হয়েছে। ছোট থেকে বড় হওয়ার জন্য তাঁদেরকে চেষ্টা করতে হয়েছে। বড় হয়ে তিনি যে সব কাজ করেছেন ছোট থাকা অবস্থায় সে সব কাজ তাঁর দ্বারা সম্ভব ছিল না।
সমাজ পরিবর্তনশীল, এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই প্রত্যেক সমাজ অগ্রসর হয়। এভাবে সমাজের প্রত্যেক ক্ষেত্রই বিকশিত হয়। এজন্য সময়ের এক পর্যায়ে যা হয় বা পাওয়া যায় অন্য পর্যায়ে তা হয় না, তা পাওয়া যায় না। আবার একই সময়ে বা একই পর্যায়ের প্রয়োজনের তাগিদে দেখা যায় একই ধরনের মানুষ, তাঁদের একই ধরনের কাজ। ক্ষেত্র বিশেষে দেখা যায় একাধিক ব্যক্তির একই রকম কাজ। একই বিন্দুতে তাঁদের অবস্থান। নিউটন এবং জার্মান দার্শনিক ও গণিতবিদ লাইবনিৎস একই সময়ে স্বাধীনভাবে আবিষ্কার করেছিলেন Differential and Integral Calculus, একই সময় আবির্ভাব হয়েছিল মার্কস এঙ্গেলস এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অক্ষয় দত্তের, আমেরিকা ও সোভিয়েট ইউনিয়নের বিজ্ঞানীরা খুব কাছাকাছি সময়ে স্বাধীনভাবে আবিষ্কার করেছিলেন আণবিক বোমা।

সমাজের বিবর্তন সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তি নিরপেক্ষ। বিবর্তনের প্রক্রিয়াই নির্ধারণ করে কখন সমাজে কি ঘটবে, কি ধরনের সব নোতুন নোতুন শক্তির উত্থান হবে, কি ধরনের ব্যক্তির আবির্ভাব হবে। এ সবের সাথে ব্যক্তির কোন সম্পর্ক নেই। সবই ব্যক্তি নিরপেক্ষ। এভাবেই ইতিহাসে আবির্ভাব হয় এক এক সময়ে, এক এক পর্যায়ে বিশেষ ধরনের ব্যক্তির। এখানে ব্যক্তি নির্ধারক নয়, ইতিহাসই আবির্ভাব ঘটায় প্রয়োজনীয় ব্যক্তির। প্লেখানভ লিখেছিলেন নেপোলিয়ান যদি না থাকতেন তাহলে তৎকালে ফ্রান্সে নেপোলিয়ানের মত অন্য এক সামরিক নায়কের আবির্ভাব ঘটতো। শেখ মুজিব না থাকলে বাঙলাদেশের স্বাধীনতা দুচার বছর, বা দুদশ বছর নয়, শতাব্দীর পর শতাব্দী পিছিয়ে যেত, এ ধরনের বক্তব্যের মধ্যে অন্য যে জ্ঞানই থাকুক, সামান্যতম ইতিহাস জ্ঞান নেই।

২৫.২.২০২৩

(বদরুদ্দীন উমর সম্পাদক, সংস্কৃতি)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Must Read

গৈরিক ভারত

১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী ভারতে জরুরী অবস্থা জারি করেছিলেন স্রেফ গদি হারানোর ভয়ে। সংবিধান প্রদত্ত ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে শুরু করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সবই বিলুপ্ত...