Homeআন্তর্জাতিকগণতান্ত্রিক সংগ্রামে স্ট্রিট আর্ট বা রাস্তার চিত্রকলার ভূমিকা

গণতান্ত্রিক সংগ্রামে স্ট্রিট আর্ট বা রাস্তার চিত্রকলার ভূমিকা

-

ঢাকার দেয়ালে গ্রাফিতি-

‘ঠক! ঠক! ঠক!
কে?

— স্যার একটু বাহিরে আসবেন?’

‘ঠক! ঠক! ঠক!
কে?

— তোরে বড় ভাই ডাকছে বাহিরে আয়!’

২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাস থেকে শহরের দেয়ালে আঁকা ‘সুবোধ’ চরিত্রটি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর অঙ্কন শিল্পী/শিল্পীরা একটি রহস্যময় প্রশ্ন তুলে ধরেন জনসাধারণের কাছে “…. হবে কি?” প্রশ্নটিকে আমরা আসলে কিভাবে দাঁড় করাতে পারি? দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে কী হবে? – এই দেয়াল চিত্রকলা ও লিখনে সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা জনগণকে ইঙ্গিত করে বোঝানো হয়েছে, বলার চেষ্টা করা হয়েছে, রাজনৈতিক নৈরাজ্য থেকে জনগণের মুক্তি হবে কি?

এখানে আমি চেষ্টা করবো এই স্ট্রিট আর্ট বা রাস্তার চিত্রকলা কিংবা দেয়াল চিত্রকলা সম্পর্কে আলোচনা করতে, বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনের দিক থেকে যা এদেশের সাধারণ মানুষের জীবন সংগ্রামকে তুলে ধরে তাদের রাজনৈতিক চেতনাকে সংগ্রামের উপযোগী করতে এবং সংগ্রামী জনতাকে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম।

শিল্পকলার কোন ধরাবাঁধা সংজ্ঞা নেই বা থাকলেও কোন সংজ্ঞাই বেশিদিন টেকসই হয়নি। টলস্টয় ভাবতেন, শিল্পকলা হবে মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় নতুন সৃষ্টি, হবে সুখবোধ। কিন্তু আজকের শিল্পকলা মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় হবে, সুখবোধ হবে এই কথা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে না। নিউ ইর্য়কের মিউজিয়াম অব মর্ডান আর্টের প্রথম পরিচালক, শিল্পকলার ইতিহাসবেত্তা আলফ্রেড বার বলেছেন, শিল্পকলার সংজ্ঞা দেওয়া বোকামী ছাড়া আর কিছু না। লন্ডনের টেট গ্যালারির প্রাক্তন পরিচালক জন রথেনস্টাইনের মতে, শিল্পীর ইচ্ছার উপর নির্ভর করে শিল্প। রেনেসা শিল্পকলা বিশেষজ্ঞ বার্নার্ড ব্যারেনসন শিল্পকলাকে ‘জীবন উন্নয়ন কর্ম’ বলে অভিহিত করেছেন; কিন্তু কি ধরনের শিল্পকর্ম যে কার জীবনকে উন্নত করবে বলা খুবই কঠিন। সুজান লেঙ্গার শিল্পকলাকে একটি অনুভূতির ব্যাপার বলে মনে করেন। অবশ্য এঁদের সবাই বলতে চেয়েছেন যে, শিল্পকলা মূলতঃ একটি অভিব্যক্তি, শিল্প ও দর্শকের মধ্যে একটি আত্মিক যোগাযোগের সেতু এবং সর্বোপরি নতুন কিছুর নির্মাণ।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলার ইতিহাস অত্যন্ত স্বল্পকালের, ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষে বৃটিশ শাসনের সমাপ্তির পরই মোটামুটিভাবে এর সূচনা। এর আগে বৃটিশ ভারতে চিত্রকলার চর্চা অত্যন্ত দূর্দিনের ভিতর কাল কাটিয়েছিল। ‘বিভাগ’ পূর্বকালে বৃটিশ ভারতে চিত্রাঙ্কন চলেছে প্রধানত ইউরোপীয় একাডেমিক ধারায়। একমাত্র বাংলাদেশেই তখন একটি ‘স্বদেশী’ চিত্রকলা আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা স্পষ্ট হয়েছিলো – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু। রবি বর্মা ইউরোপীয় আঙ্গিকে ভারতীয় চিত্রকলাকে ঢালতে চেয়েছিলেন, কিন্তু খুব একটা সফলতা পাননি।

১৯৪৮ সালে ঢাকায় দেশের প্রথম আর্ট স্কুলের প্রতিষ্ঠাকালে আমাদের চিত্রকলায় ঐতিহ্য ছিলো নব্য-ভারতীয় চিত্রকলা, লোকজ চিত্রকলা এবং ইউরোপীয় একাডেমিক চিত্রকলা। এছাড়া আর কোনো উল্লেখ্যযোগ্য আধুনিক শিল্প ঐতিহ্য এদেশে ছিলো না তখন। স্মরণীয় যে ইতিপূর্বেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হয়েছে এবং তার পূর্ববতী চার দশকের বিশ্ব চিত্রকলায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। যার মধ্যে কিউবিজম, ফিউচারিজম, স্যুররিয়ালিজম, এক্সপ্রেশনিজম, পিওরিজম, কনস্ট্রাকটিভিজম, প্রভৃতি গুরুত্বপুর্ণ আন্দোলনের অবদান উল্লেখযোগ্য। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের চিত্রকলায় ইউরোপীয় বিমূর্ত, কিউবিস্ট, স্যুররিয়ালিস্ট এবং আধুনিক লোকজ শিল্পকলার প্রভাব ছিল। কিন্তু এর পরবর্তী এদেশের শিল্পীরা প্রধানত আমেরিকান এ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজম জাতীয় চিত্র নির্মাণে উৎসাহী হয়ে পড়েন।

বাংলাদেশের নির্বস্তুক শিল্পকলা বিকাশ লাভ করেছে পাকিস্তানে সামরিক শাসন চলাকালে। এই শিল্পকলা একান্তভাবে ধর্মনিরপেক্ষ। বিষয়বস্তুতে তো নয়ই, এমনকি এই শিল্প প্রয়াসের কৃত্রিম ফর্ম সমূহের সাথেও কোনো ধর্ম, সমাজ বা মিথ কোনো কিছুরই উল্লেখ বা সাদৃশ্য পাওয়া যাবে না। অথচ একই সময়ে পাকিস্তান, ইজরাইল, এমনকি ভারতেও ধর্মীয় উপাদান বিশিষ্ট প্রচুর ছবি আঁকা হয়েছে আধুনিক আঙ্গিকে। আধুনিক চিত্রকলার অন্যতম দিকপাল মার্ক শাগাল অসংখ্য শিল্প নির্মাণ করেছেন যার ভিত্তি ইহুদী ধর্ম। কিংবা পাকিস্থানের অন্যতম আধুনিক শিল্পী সাদেকিন তার ছবির উপাদান নিয়েছেন ইসলামী ক্যালগ্রাফী থেকে। অথচ আশ্চর্যের বিষয় একই সময়ে বাঙালী শিল্পীরা প্রায় স্বজ্ঞানে ধর্ম উল্লেখ বর্জন করেছেন। ইসলামী পাকিস্তানে এই ঘটনা নিঃসন্দেহে বিষ্ময়কর। ইউরোপীয় বিমূর্ত শিল্পধারা গ্রহণ কি তাহলে তাদের তৎকালীন রাষ্ট্র দর্শনের প্রতি বিদ্রোহের প্রতীক? নাকি সে সময়কার অগ্রহণযোগ্য সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে পলায়নের অন্য নাম? ১৯৬৯-এ এদেশের শিল্পীরা নানা গণঅন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন; শহীদ মিনারে প্রতিবাদী ব্যানারে চিত্রকলা প্রর্দশনীর ব্যবস্থা করেছেন। গণমত প্রভাবিত করতে এইসব শিল্পীর শিল্পকর্ম যে ভূমিকা রেখেছে তাতে সন্দেহ নেই। ১৯৭১ সনে ‘বাংলা চারু ও কারুশিল্পী সংগ্রাম পরিষদ’ নামের ব্যানারে ঢাকার শিল্পীসমাজ ‘স্বাধীনতা’ এই শব্দকে ধারন করে রাজপথে বেরিয়ে এসেছিলেন, নেতৃত্বে ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। স্বাধীনতা সংগ্রামে একজন চারুশিল্পীও পাকিস্তান সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে দেশের মুক্তি সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিলেন এমন শোনা যায়নি। মুক্তি সংগ্রামে চারুশিল্পীদের যেমন ঝাঁপিয়ে পরতে দেখা গেছে, আবার যুদ্ধ পরবর্তী শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিনকে দেখা গেছে বৃষ্টির ভেতর ভিজে ভিজে হেটে গিয়ে বাকশাল প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবকে ফুলের মালা পরিয়ে অভিনন্দন জানাতে। উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এটা বলা যায় যে, সম্মিলিতভাবে এ দেশের শিল্পীরা এখনও ততটা প্রতিবাদী নন, সেই অর্থে প্রগতিবাদীও নন। সুতরাং এই আলোচনার প্রেক্ষিতে প্রশ্ন রাখা চাই –

আমাদের চিত্রকলা কি সমাজ পরিবর্তন করতে সহায়ক কোন ভূমিকা পালন করছে? চিত্রকলা কতটাই বা পারে সমাজ পরিবর্তন করতে? আধুনিক ইজেল পেইন্টিং বা গ্যালারী আর্ট মূলতঃ কাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করছে? বক্তব্যহীন, আংশিক ও খণ্ডিত শিল্প কি সাধারণের জন্য কোনো অর্থ বহন করে?

এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে প্রাসঙ্গিকভাবে ম্যুরাল নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলা দরকার।

‘ম্যুরাল’ শব্দটির এক কথায় অর্থ হলো দেয়ালচিত্র বা স্ট্রিট আর্ট। ম্যুরাল শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ মুরুস থেকে। যার অর্থ দেয়াল। ১৯১০ সনে মেক্সিকো বিপ্লবের পর থেকেই সে দেশের বিপ্লবী সরকারের পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করতে থাকে সেখানকার শিল্পী সমাজ। মেক্সিকোর জন্য এক ঐতিহাসিক ঘটনা হলো বিপ্লবোত্তরকালে সে দেশে কয়েকজন অত্যন্ত শক্তিশালী শিল্পীর আবির্ভাব। এরা ছিলেন একাধারে শিল্পী এবং সংগ্রামী। মেক্সিকোর নতুন শিল্পকলা সৃষ্টিতে এই বিপ্লবী শিল্পীগণ নেতৃত্ব দেন। ওরোজকো, রিভেরা, সিকিরোসের মতো শিল্পীর সবাই ছিলেন প্রগতিশীল এবং পার্টির সদস্য। তাঁরা ছিলেন দেশপ্রেমিক, ঐতিহ্য ও লোকশিল্পের আন্তরিক অনুরাগী; আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠতা তাঁদের শিল্পকলায় একাধারে জাতীয়তাবাদ ও প্রগতিশীলতার সমন্বয় ঘটাতে সক্ষম হয়।

১৯২১ সনে ডেভিড আলফারো সিকিরোস তাঁর বিখ্যাত এক ইশতেহার প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি ইউরোপীয় ধারার ইজেল পেইন্টিং এর বিরুদ্ধাচারণ করেন এবং ম্যুরাল তথা গণশিল্পের পক্ষে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, ছবির আঙ্গিকের সাথে বক্তব্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তৎকালীন পাশ্চাত্য ধারার বিমূর্ত ইজেল চিত্রকলা যে মূলতঃ বক্তব্যহীন, সে কথাই তিনি বলতে চেয়েছেন। তাঁর কথায় সমাজে শিল্পকলা হবে সবার জন্য এবং সেই গণশিল্প নির্মিত হবে মহান ও বিপুল আয়তনে, বহিরাঙ্গণে, বিভিন্ন গণভবনে ও গণপ্রতিষ্ঠানের বিরাট বিরাট দেয়ালে প্রধানত ম্যুরাল চিত্র হিসেবে। এই শিল্প হবে বক্তব্যপ্রধান, ফিগারেটিভ ও সামাজিক বাস্তবতা ভিত্তিক; তা হবে মৌলিক চরিত্র ভিত্তিক এবং আধুনিক উপকরণ, কৌশল ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিসম্পন্ন। চিত্রে ব্যক্তিগত স্টাইল প্রতিষ্ঠার চাইতে জাতীয়তাবাদ ও মানবতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশই হবে এই শিল্পের মুখ্য উদ্দেশ্য। ইউরোপীয় আধুনিক ইজেল পেইন্টিং বা গ্যালারী আর্ট মূলতঃ ধনতান্ত্রিক সমাজের মুষ্টিমেয় ব্যক্তির স্বার্থে নিয়োজিত। গণস্বার্থ বিরোধী শিল্পের বিপরীতে তিনি দাঁড় করালেন পাবলিক আর্ট বা সিকিরোসের ভাষায় ‘ইন্টেগ্রাল আর্ট’ র্অথাৎ সমন্বিত শিল্পকলা।

একটি চিত্র বা পেইন্টিংকে ঘরের দেয়ালে সাজাবার জন্য ব্যবহার করার কথা মেক্সিকোর বিপ্লবী শিল্পীরা ভাবতে পারেননি; তাঁদের কাছে একটি গোটা পরিবেশ, একটি গোটা ভবন, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলায় এক ও অভিন্নভাবে পরিকল্পিত হবে। আর এই কাজ করবেন স্থপতি, ভাস্কর, ও চিত্রশিল্পী সকলেই সমন্বিতভাবে, যৌথ প্রচেষ্ঠায়। ১৯২০ থেকে ১৯৫০ এর মধ্যে মেক্সিকোতে এই ধরনের ম্যুরাল চিত্র বা সমন্বিত গণশিল্প অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বহু গুরুত্বপূর্ণ ভবনে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই ধরনের শিল্পকলা বাস্তবায়িত হয়। রিভেরা এবং সিকিরোসের মত শিল্পীরা মেক্সিকোর বাইরেও বিভিন্ন দেশে এই ম্যুরালের কাজ করেছেন।

শিল্পীর স্বাধীনতা প্রশ্নে ডেভিড সিকিরোস মেক্সিকান শিল্পীদের মতামত সহ তাঁর নিজের মতামত তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে সর্বহারার স্বার্থ সংরক্ষণ করা এবং তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সংগ্রামী বক্তব্য সম্পন্ন ফিগারেটিভ বা অবয়বী আঙ্গিক ভিত্তিক সামাজিক বাস্তবতার ছবি আঁকাই হলো সমাজে শিল্পীদের দায়িত্ব।

লেনিন বলেছেন, যে কোন ব্যক্তির (শিল্পীর) কর্মের সাফল্য নির্ভরশীল তার নিজ জাতীয় সমাজব্যবস্থার উপর। মাও সে তুং শিল্পীর স্বাধীনতা সম্পর্কে বলেছেন যে, শিল্পীরা নিজেরাই তাদের দায়িত্ব ঠিক করে নিবে। এ কথা উল্লেখ করা বাহুল্যমাত্র যে, ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ও সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় শিল্পীর দায়িত্ব অথবা শিল্পের প্রকৃতি একরূপ হতে পারে না। আইডিওলজিক্যাল রাষ্ট্রে, এমনকি বর্তমান যুগের কোন কোন অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল ধনতান্ত্রিক দেশেও স্বীকার করে নেয়া হয়, সমকালীন আধুনিক শিল্পকলা বক্তব্যহীন হতে পারে না, হওয়া উচিত নয়। বিমূর্ত ও নৈরাজ্যবাদী চিত্রকলা শুধুই অর্থহীন কাজ ছাড়া আর কিছুই নয়।

শিল্পীর অবাধ স্বাধীনতা সম্পর্কে কারো কোনো দ্বি-মত নেই, কিন্তু অবাধ স্বাধীনতা কেবলমাত্র অত্যন্ত দায়িত্বসম্পন্ন, জাতীয় মূল্যবোধ ও মানবিক চেতনাসম্পন্ন ও কুশলী শিল্পীর জন্যই সংরক্ষিত থাকতে পারে; এটা মাও-এর গণচীনের জন্য যেমন খাটে, প্লেটোর রিপাবলিকের জন্যও এবং সিকিরোসের মেক্সিকোর জন্যও। সিকিরোস তাঁর Art and Revolution গ্রন্থে বলেন, আমরা অবয়বী চিত্রকলায় বিশ্বাসী করি এবং মনে করি যে অবয়বী চিত্র ও বাস্তবতার চিত্র সমার্থক। অতএব এইভাবেই একটি বিপ্লবী সমাজে শিল্প ঐতিহ্য গড়ে উঠে, শিল্পীর স্বাধীনতা ও বক্তব্য কি হবে তাও শিল্পীরাই নির্ধারণ করে। শিল্পীরা বিপ্লবী হলে তাদের শিল্পর্কম ও বিপ্লবী চেতনাসম্পন্ন হবে বলাই বাহুল্য।

ম্যুরাল এর আরেক প্রতিরূপ হলো গ্রাফিতি। গ্রাফিতি শব্দের উৎপত্তি, গ্রিক শব্দ গ্রাফেইন (graphein) থেকে যার অর্থ ‘লেখা’। এটি মূলত ভাষা ও শিল্পের এক অনন্য সমন্বয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একটা দেয়ালচিত্র বেশ আলোচিত হয়ে উঠেছিলো – ‘Kilroy was here’ – কিলরয় নামের সেই দেওয়াল চিত্রে দেখা যায়, একটা টেকো মাথার লম্বা নাকওয়ালা লোক দেয়াল ধরে বসে আছে, অথবা দু’হাতে ভর দিয়ে বিশাল লম্বাকায় নাকটা দেয়ালের উপরিভাগে ঝুলিয়ে দিয়ে উঁকি মারছে, সাথে লিখা Kilroy was here। অতি সাধারণ এ অঙ্কনটি তখন ছড়িয়ে পরেছিলো যুক্তরাষ্ট্রের দেয়ালে দেয়ালে। জার্মানরা ভাবতে শুরু করে এটা নিশ্চয়ই আমেরিকান কোনো গুপ্তচরের সংকেতিক নাম। অথচ এই কিলরয়ের রহস্য আজও অজানা। এই সাদামাটা গ্রাফিতিই সে সময় আলোচ্য হয়ে উঠেছিলো বিশ্বযুদ্ধের দামামায়। এর অন্তনির্হিত অর্থ খুঁজতে থাকেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালকরা।

গ্রাফিতিকে বলা হয় কাউন্টার কালচার, অর্থাৎ গতানুগতিক সংস্কৃতির বিপরীতে। যে শিল্পকর্মটি প্রচলিত রীতি-নীতি সিদ্ধান্তের বিপরীতে গিয়ে এক ধরনের শিল্প গড়ে তোলে। সমসাময়িক সমাজ জীবনে যে চরম সংকটাবস্থা বিরাজ করছে তাকে বিষয়বস্তু করেই গড়ে উঠেছে গ্রাফিতি শিল্প। সংস্কারাচ্ছন্ন এই সমাজে বিদ্রোহী চেতনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে গ্রাফিতি। এর উপাদান মূলতঃ সমাজের অবক্ষয়, উৎপীড়ন, নিপীড়ন, শোষণ ও শাসন, রাজনৈতিক অরাজকতা, স্বেচ্ছাচারতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ইত্যাদি।

গ্রাফিতিতে উঠে আসে সমাজের সমসাময়িক বিশৃঙ্খলার এক ব্যাঙ্গাত্মক রূপ, যা চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় কোন অব্যবস্থায় বাস করছি, কি-ই বা এর পরিণতি। স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তা-ভাবনা প্রকাশের মাধ্যম গ্রাফিতি, আর এই স্বতঃজাত ভাবনা প্রকাশের স্থান দেয়াল। বিশ্বের সকল দেয়াল একজন গ্রাফিতি শিল্পীর জন্য উন্মুক্ত ক্যানভাস। তাই বিভিন্ন দেশের দেয়ালে আমরা দেখতে পাই প্রতিবাদ, মুক্তচিন্তা, দেখতে পাই সে দেশের প্রকৃত দৃশ্য গ্রাফিতি শিল্পী বা গেরিলা শিল্পীদের চিত্রকলার মাধ্যমে। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে গ্রাফিতি আন্দোলনে দ্বিগুণ মাত্রা যোগ করে এমন দৃষ্টান্ত দেখা গেছে বহু সময়ে, বহু দেশে। তার কিছু খন্ডচিত্র তুলে ধরতে চেষ্টা করছি।

  • ১৯৬৮ সালের মে মাসে প্যারিসে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে, তাদের সঙ্গে ফরাসী শ্রমিকেরাও যোগ দিয়ে আন্দোলনে নতুন মাত্রা দেয়। পুঁজিবাদের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে তরুণরা তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে উঠে পড়ে লাগে। তারা স্বপ্ন দেখতো রক্ষণশীল ভাবধারা ও কড়া নিয়মের বেড়াজালে বাধা শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেওয়ার, স্বপ্ন দেখতো বৈষম্যহীন সমাজের, স্বপ্ন দেখতো সাম্যব্যবস্থা ফিরে পাওয়ার। অসংখ্য প্রাণ যায়, অসামান্য ক্ষতিগ্রস্ততা, গণগ্রেফতারকৃত ছাত্র-শ্রমিক-জনতা রাত-দিন এক করে এই আন্দোলন করে যায়। শুরুতে মুখের ভাষাকে পুঁজি করে নয়, তারা হাতিয়ার করে দেয়ালচিত্র এবং দেয়াললিপিকে। লেখনি ও আঁকিয়েদের ধার মনে দাগ কাটে ফ্রান্স সহ গোটা বিশ্ববাসীর। সর্বস্তরের মানুষের মনে একটা বড় পরির্বতন আনে। ছোট ছোট বিষয়ে জয়ী হতে শুরু করে তারা। এরপর একসময় সরকারের পতন হয়। সে দিনের ছাত্র আন্দোলনের সফলতার ছায়া পড়েছিলো দুনিয়া জুড়েই।

এই আন্দোলনের সময় ছিল বহুদিনের। এই আন্দোলনকে তারা নতুন রূপ দেয় গ্রাফিতি এবং দেয়াললিপির মাধ্যমে। ফরাসি ছাত্র আন্দোলনের অসামান্য কৃতিত্ব এই সকল অবাচনিক যোগাযোগ মাধ্যমের। প্রত্যেকটি এত রূঢ়, এত সত্য, এত স্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরেছিলো যা হয়তো বাচনিক যোগাযোগকেও হার মানায়। সে সময়কার কিছু শক্তিশালী লেখনিচিত্র তুলে ধরা হলো:

#আমরা সেই ব্যবস্থা চাই / যা জনগণের সেবা করবে / এমন ব্যবস্থা না / যার সেবা জনগণকে করতে হয়।

#মালিকের সঙ্গে কোন দরাদরি নয় / উচ্ছেদ করো তাকে / মালিকেরই তোমায় দরকার / মালিককে তোমার দরকার নাই কোনো।

#শ্রেণী সমাজের বিলোপ ঘটাও / প্রকৃতি না কাউকে দাস করেছে, না প্রভু / শাসিত কিংবা শাসক / চাই না হতে কিছুই।

#বাঁচার অধিকার চাইতে যেও না / ছিনিয়ে নাও।

#সমস্ত রোমাঞ্চ যে সমাজ শেষ করেছে / শেষ করো তাকে / সে-ই তোমার শেষ রোমাঞ্চ।

#মানবের মুক্তি / হয় সম্পূর্ণ / না হয় শূন্য।

#চুলায় যাক এই রাষ্ট্র / জাতীয় সংসদ যখন বুর্জোয়াদের মঞ্চ হয়ে দাঁড়িয়েছে / ওদের সব মঞ্চকে তখন জাতীয় সংসদে বদলে দেওয়া দরকার।

#১৯৬৮ তে স্বাধীন হতে চাও / মানে অংশ নাও / আমি অংশ নিচ্ছি /তুমি অংশ নিচ্ছো / আমরা সবাই অংশ নিচ্ছি।

#বিছিন্নতা দূর করো / মান্যতার শূন্য চেতনায় / চেতনার শুরু অমান্যতায় / আগে অমান্য কর / তারপর লেখ দেয়ালে / দেয়ালে লিখতে আমার ভাল লাগে না / সবখানে লেখ।

এই দেয়াললেখনি এবং গ্রাফিতি বহন করছে অগ্নিশক্তি। কথাগুলো যেমন সত্য, সুন্দর ছবিগুলো তেমন উন্মুক্ত-বিশুদ্ধ। যেন শুধু ছবি নয় তারাও কথা বলছে। স্পষ্ট করে দেখাচ্ছে সামাজিক রাজনৈতিক সমস্যা, বুর্জোয়াদের ক্ষমতার জোর আর শোষিত শ্রেণীর অধিকার আদায়ের সংকল্প।

  • আশির দশকের মাঝামাঝিতে সামাজিক অসঙ্গতি, যুদ্ধ বিরোধী অবস্থান ও স্নায়ুযুদ্ধের রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার প্রতিবাদ হিসেবে শক্তিশালী নীরব আন্দোলন হয়ে উঠেছিলো বার্লিন প্রাচীরের গ্রাফিতি। সারা ইউরোপকেই বিভক্ত করা এই প্রাচীর একটা সময় সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ লিপিবদ্ধকরণের স্থান হয়ে উঠেছিলো। বার্লিন শহরের সাধারণ মানুষের আবেগ ও বিশ্বের গ্রাফিতি শিল্পীদের তাবৎ রঙ প্রাচীরকে রাঙাতে থাকলো।
  • গ্রাফিতি শিল্পীর উদ্দেশ্য স্থায়িত্ব নয়, তার সৃষ্টি মানুষের দৃষ্টি আর্কষণের জন্য, সংযোগ স্থাপনের জন্য, সচেতন হওয়ার জন্য, প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য। বলা যায় এটা হলো তাৎক্ষণিক শিল্প। ১৯৮০ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের কতগুলো এলাকায় সব STOP সাইনের নিচে সাদা রঙে RAPE শব্দটি লিখে দেওয়া হয়। ফলে রাতের বেলা গাড়ির আলো এই STOP সাইনের ওপর পড়লে স্টপ হয়ে যায় STOP RAPE। শহরের গুরুত্বপূর্ণ অংশে এভাবে মানুষের দৃষ্টি আর্কষণ করে ধর্ষণ বিরোধী বার্তা পৌছে দেন গ্রাফিতি শিল্পীরা। এরপর একইভাবে লেখা হয় নিকারাগুয়ায় মার্কিন গণহত্যা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় মার্কিন আগ্রাসন নিয়ে। এভাবে এই স্টপ শব্দটি পরিণত হয় সরকার বিরোধী স্লোগানে।
  • অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে আন্দোলনকারীরা বেছে নিয়েছিলো গ্রাফিতির পাশাপাশি ‘মিম’ (meme)। এই আন্দোলনের মূলে রয়েছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদের অসম বণ্টন এবং পুঁজিবাদী স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ উত্থান। আন্দোলনকারীরা বলছিলো যে, দেশের শতকরা ৯৯ ভাগ সম্পদ রয়েছে মাত্র শতকরা ১ ভাগ লোকের হাতে। এ কারণেই কালক্রমে দেশের শাসন, সামাজিক স্তর এবং জনগণের বিভিন্ন শ্রেণীর মাঝে গভীর ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। আমেরিকার পুঁজিবাদী ব্যবস্থা একটি অন্যায় এবং বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা। এই সরকার ব্যবস্থা একটি সংখ্যালঘু ধনীক শ্রেণীর সৃষ্টি করে এবং সমাজের অপরাপর শ্রেণীগুলোকে শোষণ করার মধ্য দিয়ে ধ্বংস করে ফেলছে। যুদ্ধের সমরাস্ত্র উৎপাদন শিল্পগুলো অস্ত্র বিক্রি করতে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়। যা একদিকে যেমন সমগ্র বিশ্বে অশান্তি এবং নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধির কারণ হয়েছে, তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সেনা সমাবেশ ও ঘাঁটি স্থাপন করেছে। এই সেনা সমাবেশের কারণে দেশের বিরাট অংকের অর্থ ব্যয় হয়। এই বিশাল খরচের প্রাথমিক চাপটি পড়ছে আমেরিকার স্বল্প আয়ের মানুষগুলোর উপর। তারা দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়েছে। আর লাভবান হয়েছে আমেরিকার যুদ্ধবাজ গুটিকয়েক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী যারা অস্ত্র উৎপাদন ও ব্যবসার সাথে সরাসরি জড়িত। এই ক্ষোভ থেকে শুরু হয় অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন। আর এই আন্দোলনকে সংগঠিত করেছিল ‘আমরাই ৯৯%’ বা ‘উই আর নাইনটি নাইন পার্সেন্ট’ – ১ ভাগ মানুষের হাতে তাবৎ সম্পদ আর ৯৯ ভাগ মানুষের বেঁচে থাকার তীব্র লড়াই। অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের মাত্রা আরো তীব্রতর হয় গ্রাফিতি আর মিম দ্বারা। যেমন কয়েকটি,

# ‘দ্য ব্যালেরিনা এ্যান্ড দ্য বুল’ ব্রডওয়ের ৭১০০ পাউন্ড ওজনের বুল বা ষাঁড়ের ভাস্কর্যের উপর একজন নৃত্যরত ব্যালে শিল্পীর মিম। এই ছবি এই বার্তা দিল যে চাইলে অবিশ্বাস্য কিছু ঘটানো সম্ভব।

# ক্রিস নামক ‘স্বল্প বেতন পাওয়া কিন্তু বেশী কাজ করা’ একজন তার মতো হাজার মানুষের কথা এক বাক্যে লিখে একটি পোস্ট দিলেন, We are 99% – এটাই হয়ে গেল আন্দোলনের প্রধান স্লোগান।

# হ্যাঙ্গড ব্যাঙ্কার, একজন স্ট্রিট আর্টিস্ট ওয়াল স্ট্রিট ব্যাঙ্কারের স্যুট টাই পড়া পুতুল তৈরী করে ফ্লোরিডার এক রাস্তার ধারে টেলিফোন তার থেকে ফাঁসির দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। তার নীচের দেয়ালে ম্যুরালে লেখা, ‘ওয়াল স্ট্রিটের একজন ব্যাঙ্কারকে পর্যাপ্ত দড়ি দাও, সে নিজেই নিজেকে ঝুলাবে’।

  • ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ব্রাজিল বিশ্বকাপ ফুটবলে পথশিল্পী পাওলো ইতোর এর আঁকা একটি গ্রাফিতিতে ক্ষুর্ধাত শিশুর সামনে ফুটবলের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বেশ ভাইরাল হয়েছিলো। এটি আঁকা হয়েছিলো আয়োজক দেশ হিসেবে ব্রাজিলের অমিতব্যয়ী আচরণের প্রতিবাদ হিসেবে।
  • গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপলিসের এক পুলিশ কর্মকর্তা কর্তৃক জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে প্রতিবাদের ঢেউ উঠে। সে সময় প্রচুর গ্রাফিতি তৈরী হয়। ক্ষুব্ধ লাল অক্ষরে স্প্রে পেইন্টে আঁকা, ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার,’ ‘উই ক্যান্ট ব্রিদ,’ এবং ‘সে হিজ নেইম’ এখন পুলিশের নৃশংসতা এবং পদ্ধতিগত বর্ণবাদী অবিচারের জন্য নিরবচ্ছিন্ন, অস্বস্তিকর স্মারক হয়ে উঠেছে।
  • পাশের দেশ ভারতেও সমসাময়িক বেশ আন্দোলনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে গ্রাফিতি। যেমন দিল্লির ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, পশ্চিবঙ্গের যাদবপুরে শিক্ষার্থী নিগ্রহের প্রতিবাদে ‘হোক কলরব’ আন্দোলন।

গ্রাফিতির সঙ্গে রয়েছে শিল্পের প্রতিবাদী রূপের বিশেষ সর্ম্পক। এর কোনো সুনির্দিষ্ট র্ফম নেই, নেই বিশেষ মাধ্যমের প্রতি কোনো আনুগত্য। গ্রাফিতি শিল্পীর কাছে পুরো পৃথিবীটাই ক্যানভাস। দেয়াল, বাড়ী, রেলের বগি, যানবাহন সবই গ্রাফিতির জন্য উপযুক্ত। নাম না জানা এক শিল্পী বার্সেলোনায় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সর্বগ্রাসী নীতির বিরোধিতা করে সরকারি দেয়ালে আঁকেন কাত হয়ে আছে পেট্রলের ক্যান আর তা থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। এ থেকে স্পষ্ট হয় মধ্যপ্রাচ্যে তেলের খনি দখলের লড়াইয়ের বহুজাতিক সংস্থা ও পরাক্রমশালী দেশগুলোর রক্তক্ষয়ী রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা।

সেই গুহা চিত্রের সময়কালের যোগাযোগ থেকেই গ্রাফিতির জম্ম বলা যায়। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই গ্রাফিতির লেখা ও চিত্রের বক্তব্যের সাথে রাজনীতি, দর্শন, সমাজ, মনস্তাত্ত্বিক বিবিধ বার্তার প্রকাশ ঘটাতে থাকে যা রচনা করে আধুনিক গ্রাফিতির নতুন মাত্রা। গ্রাফিতি আমাদের চলিত পরিস্থিতিকে মনে করিয়ে দেয়। তা সাহসকে রক্ষা করে। অনুভূতিকে গভীরে নিয়ে যায়। প্রতিকূলতাকে র্স্পশ করে। ভৌতিক ভোজবাজি অপছন্দ করে। এটি এক ধরনের ছন্দময় আর্ট। যা মানুষকে বোধ ও বুদ্ধির দাপটকে শানিত করে, ঘটায় তার প্রাঞ্জল স্ফূরণ। গ্রাফিতি পৃথিবীর বড় বড় আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ করেছে। এবং সে প্রত্যক্ষণের পরিচর্যাও করেছে, আপ্রাণ শক্তিতে, চরম তীব্রতায়। নানান সময়ে নানান উপলক্ষে রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার একটা শৈল্পিক মাধ্যম হিসেবে পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি আমাদের দেশেও গ্রাফিতি অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের সব আন্দোলনে দেয়াল লিখন বা গ্রাফিতি চিত্র জড়িয়ে ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে। সেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ‘রাষ্ট্র ভাষা বাঙলা চাই’ থেকে শুরু করে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ এসব গ্রাফিতি বিভিন্ন সময়ে দেখতে পাওয়া যায় দেয়ালে দেয়ালে।

এবার ঢাকার দেয়ালে আঁকা কিছু গ্রাফিতি নিয়ে বলি। নব্বইয়ের দশকে ‘কষ্টে আছি – আইজুদ্দিন’ দেয়াল লিখনটি বেশ নজর কেড়েছিলো সেই সময়কার সাধারণ মানুষের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ব্রিটিশ কাউন্সিলের উল্টোদিকে শিক্ষকদের বহুতল আবাসনের সীমানা দেয়ালে কালো অক্ষরে দরদ মিশিয়ে লিখেছেন ‘কষ্টে আছি – আইজুদ্দিন’। এই তিনটি শব্দ মিলেই তৈরী তার বেদনার সীলমোহর। তার বিশ্বাস দু-চারজন লম্পট ও বেপরোয়া দলবাজ শিক্ষক বাদ দিলে রাস্তার এপারে ওপারে বেশ কজন ভাল মানুষ বাস করেন। ভালো মানুষ, ভাল শিক্ষক। ভাল শিক্ষকরা তার কষ্টের কথা জেনে রাখুক। তারা অন্তর দিয়ে অনুভব করবেন এবং শিক্ষার্থীদের অনুভুতিকে আরো সংবেদনশীল করে তুলবেন।

পরের দশকে দেখা গেল আরেকটি দেয়াল লিখন ‘অপেক্ষায় – নাজির’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সেই মাধবকুণ্ড কিংবা কক্সবাজার, যেখানেই যান দেখা পাওয়া যেত সেই ‘অপেক্ষায় – নাজির’।

বছর পাঁচেক আগে বেশ কমাস ধরে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ দেয়ালে দেয়ালে কিছু ছবি আর লেখা দেখা গেল। ছবিতে দেখা যায় উস্কোখুস্কো চুলদাড়ির এক পলায়নরত যুবক। গ্রাফিতিগুলোর মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায়।

# খাঁচাবন্দি টকটকে লাল সূর্য হাতে দাঁড়িয়ে আছে সুবোধ নামের উস্কোখুস্কো চুলদাড়ির এক যুবক, পাশে লেখা “সুবোধ তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছুই নেই।”

# আরেকটি চিত্রে খাঁচাবন্দি সূর্য্য, লাল নয়, হলুদ। সুবোধকে দেখে মনে হয় দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। পাশে লেখা, “সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না।”

# মাটিতে রাখা খাঁচাবন্দি সূর্য্য, এলোমেলো চুলের সুবোধ খাচাটি নিয়ে দৌড়াতে উদ্যত। এতে লেখা, “সুবোধ তুই পালিয়ে যা, ভুলেও আর ফিরে আসিস না।”

# খাঁচাবন্দি সূর্য্য এবং সুবোধ নেই, শুধু লোগোটি আছে। লিখাটা হলো, “সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন মানুষ ভালবাসতে ভুলে গেছে।”

সাম্প্রতিক কিছু আন্দোলনের গ্রাফিতি চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি যাতে সুবোধের সাথে যোগসূত্র স্থাপিত হয়। বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিবাদ প্রতিরোধের ভাষা হিসেবে বুয়েটের দেয়ালে দেয়ালে উঠে এসেছিলো গ্রাফিতি চিত্র। এমনই একটি চিত্রে দেখা যায় কচ্ছপের পিঠে ‘বিচার’ বুয়েটের তিতুমীর হলের দেয়ালজুড়ে আঁকা হয়েছে বেশকিছু গ্রাফিতি। পাশের হলটাই শেরে বাংলা হল। এই হলে ২০১১ নম্বর রুমে প্রশাসনের সহযোগিতায় ছাত্রলীগ নেতারা নির্মমভাবে হত্যা করেছিলো বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদকে। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধের ডাক দিয়েই দেয়াল জুড়ে আঁকা হয়েছিলো প্রতিবাদ চিত্র। এই সকল গ্রাফিতিতে উঠে এসেছে শাসক শ্রেণীর ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের দমন-পীড়ন নির্যাতন এবং প্রতিবাদ প্রতিরোধের নানান ছবি। একেকটি ছবি যেন আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ বার্তা হয়ে শোভা পাচ্ছে বুয়েটের দেয়ালে দেয়ালে। দেয়াল জুড়ে আঁকা এইসব প্রতিবাদের চিত্রে দেখা যায় মুষ্টিবদ্ধ হাত পাশে লেখা ‘হোক প্রতিবাদ’, মর্গে পড়ে থাকা লাশের পাশে রোল নাম্বার, আবরারের বাবার আর্তনাদরত ছবির পাশে লেখা “পারবে আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে!” দেয়ালে আরেকটি গ্রাফিতিতে দেখা যাচ্ছে চোখ বাঁধা তরুণের দিকে বন্দুকের নল আকৃতির আঙ্গুলের নিশানায় নিরাপত্তা লুন্ঠণের ইঙ্গিত। কোনটিতে ‘হোক কলরব’ লেখা। একটি চিত্রে রয়েছে শিয়ালের খপ্পরে আটকে পরা মুরগীর ছবি, দাবার বোর্ডে আবরার ফাহাদ নামটিকে ঘিরে রেখেছে হেলমেট, নিচে চেকমেট কেটে লেখা হয়েছে ‘ডেথমেট’। ডানা মেলা পাখির গলায় শেকল, ২০১১ নম্বর কক্ষের সামনে পরে থাকা লাশ, দেয়ালে দেয়ালে এই গ্রাফিতিগুলো শাসক শ্রেণীর রাজনীতির নামে দমন-পীড়ন নির্যাতন, গুম-হত্যা-খুন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে আন্দোলিত করেছে সাধারণ মানুষের চিন্তা চেতনাকে।

২০১৮-র ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’ বাংলাদেশে কার্যকর সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট ২০১৮ পর্যন্ত সংঘটিত একটি আন্দোলন বা গণবিক্ষোভ। ঢাকায় ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দ্রুতগতির বাসে চাপা পড়ে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া নিহত হয় ও ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। এই সড়ক দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে নিহত দুই কলেজ শিক্ষার্থীর সহপাঠিদের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ পরবর্তীতে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরিবহন মালিক ও ‘শ্রমিকদের’ নেতা নৌমন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন ও অবরোধ করতে চাইলেও দুর্ঘটনার পরদিন থেকেই পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার চেষ্টা করে; পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগ ও সরকারী দলের সমর্থক যুবকেরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ছাত্রছাত্রী ও সাংবাদিকদের ওপর হামলা করে। সরকার প্রচুর সংখ্যক আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করে। ছাত্রছাত্রীদের ওপর সরকারের দমনপীড়নমূলক ব্যবস্থা দেশে ও বিদেশে তীব্রভাবে নিন্দিত হয়। আন্দোলনকারীরা দেয়ালে, রাস্তায়, গাড়ীতে, নিজ শরীরে, স্কুল ব্যাগে, শার্টে সহ হেন জায়গা নেই যেখানে চিত্র ও লিপিতে তাদের প্রতিবাদ তুলে ধরে। প্রতিবাদের ভাষা কখনও কোমল, সুশ্রী, মোলায়েম হবে তা আশা করা যায় না। ছাত্রদের দেয়াল লেখনিতে উঠে এসেছে –

# যদি তুমি ভয় পাও / তবে তুমি শেষ / যদি তুমি রুখে দাঁড়াও / তবে তুমি বাংলাদেশ

# উন্নয়নের মহাসড়কে / এগিয়ে চলছে দেশ / বাসের নীচে ছাত্র মরে / সোনার বাংলাদেশ

# প্রিয় পুলিশ!! যে কাঠামো ও ব্যবস্থা তোমাকে সন্তান খুন করায় তুমি তার বিরুদ্ধে দাঁড়াও / ঘুরে দাঁড়াও

# আমার দেশ, আমার গর্ব / দেশ মেরামত, আমরা করবো

# দেশে আইন আছে!! আইনের প্রয়োগ কোথায়? আইন = ঘুষ

# আমার ভাই রক্তে লাল / পুলিশ কোন চ্যাটের বাল

# কাঁদতে আসিনি / চালকের ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি

# আমরা না হয় আন্দোলনের নামে সস্তা পাবলিসিটি করতেছি / কিন্তু!! গত ৪৭ বছরে আপনারা কোন বালডা ছিড়েছেন??

২০১৮-র আরেকটি আন্দোলন ছিল ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’। কাজের খোঁজে অস্থি’রতা, হতাশা আর ক্ষোভ থেকেই কোটা সংস্কার আন্দোলন দেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিস্তৃত হয়। সরকার এ বিষয়ে কোনো যুক্তিসঙ্গত আলোচনা ও সমাধানের পথ না খুঁজে প্রতারণা ও নিপীড়নের পথ বেছে নেয়। ছাত্রলীগের আক্রমণ, পুলিশের মামলা ও নির্যাতন, আদালতের রিমান্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্যাতনকারীদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণের সাথে যোগ হয় নারী শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন আক্রমণ। প্রতিদিনই আন্দোলনকারীদের উপর হামলা হতে থাকে, ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আন্দোলনকারীদের উপর ছাত্রলীগ একাধিকবার আক্রমণ করে, শিক্ষকরাও তাদের হামলা থেকে রক্ষা পায়নি। এই আন্দোলনের দেয়াল লিখনে ছিল- ‘কোটা প্রথা নিপাত যাক, মেধাবীরা মুক্তি পাক,’ ‘আমি নারী- মেধা দিয়েই করবো বিশ্বজয়, কোটা আমার জন্য নয়,’ ‘মেধা হোক সবচেয়ে বড় কোটা’ ইত্যাদি।

বর্তমান সময়েও এসব গ্রাফিতি অঙ্কনের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। প্রেক্ষাপট অনুযায়ী গ্রাফিতিগুলো সমসাময়িক দুঃসাহসিক বার্তা বহন করে চলছে। কিছুদিন পূর্বে ঢাকার দেয়ালে নতুন করে গ্রাফিতি নিমার্ণ করা হয়েছে ‘হেলমেট ভাই’ নামে। গ্রাফিতিতে দেখা গেছে সুপারম্যানের সাজে মাথায় হেলমেট পড়ে একজন দাঁড়িয়ে আছে। তাতে বিজ্ঞাপনের ভাষায় লেখা রয়েছে বাজারে আসছে নতুন কমিকস ‘হেলমেট ভাই’, প্রাপ্তিস্থান ‘গেস্টরুম’ ও প্রকাশক ‘সহমত ভাই’। এটা উপলব্ধি করা কঠিন নয় যে ‘সহমত ভাই’ কথাটির ব্যবহার মূলতঃ ব্যাঙ্গাত্মক অর্থে, এর মধ্যদিয়ে শাসক দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের চরিত্রের প্রসঙ্গটিও চলে এসেছে। যারা ক্ষমতায় দাপট দেখিয়ে প্রতিপক্ষদের দমন করে, দুর্বলদের আঘাত করে, তাদের যে কোনো কাজের সঙ্গে মতামতের অমিল প্রকাশ করলে নির্যাতন বা হুমকির শিকার হতে হয় বলে সব কথায় সমর্থন দিতে হয় তাদেরকেই ‘সহমত ভাই’ হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিরোধের আন্দোলনের রেশ ধরেই এই ব্যাঙ্গাত্মক গ্রাফিতির জন্ম। বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগোর আকৃতিতে এই ‘সহমত ভাই’ গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে। আর প্রতিষ্ঠানের নামের জায়গায় লেখা হয়েছে ‘মেশিন’। সাধারণ ছাত্ররা এসব থামাতে না পেরে গ্রাফিতির মাধ্যমে দেয়ালগুলোতে প্রতিবাদের নতুন ভাষা জনগণের সম্মুখে আনছে। তাই যখনই নতুন কোনো গ্রাফিতির দেখা মেলে নগরবাসী, বিশেষ করে তরুণরা, তা নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠে। কিন্তু এর আসল উদ্দেশ্য নিয়ে কিংবা সমস্যা সমাধানে চেষ্টা কম।

আমি আমার আলোচনায় সুবোধ চরিত্রের গ্রাফিতির কয়েকটি চিত্র নিয়ে আলোচনা করেছি। ‘কষ্টে আছি – আইজুদ্দিন’ কিংবা ‘অপেক্ষায় – নাজির’ সমসাময়িক রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের প্রতিছব্বি। সমাজের মোড় ঘোরাতে এখন সুবোধের ফেরা দরকার। সুবোধ পালাবে না, সুবোধ রুখে দাঁড়াবে। অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে ন্যায় যুদ্ধের ঘোষণা দিবে। গ্রাফিতিগুলো যদি সত্যিই প্রতিরোধের আন্দোলনের হাতিয়ার হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের উচিত প্রতিরোধ আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করা, সমর্থন দেওয়া, আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পরা।

‘তবুও সুবোধ রাখিস সূর্য্য ধরে’- এই ‘তবুও’ শব্দটি বড় আশাজাগানিয়া, বড় আত্মবিশ্বাসী। ওই আশা নিয়ে সংগ্রামের মধ্যে বাঁচতে হবে। সুবোধ হলো এই সমাজ বা রাষ্ট্রের জনগণ, এটা বুঝতে নিশ্চয় আর কারো বাকী নেই। ‘কবে হবে ভোর?’- সুবোধকে পালাতে দিতে পারি না। পালানো কোনো সমাধান নয়, তাই ঘুরে দাঁড়াতে হবেই। ভোর একদিন হবেই।

নামহীন চিরকুট, পোস্টার, দেয়াললিপি, পথচলিত শব্দ, কথ্য শব্দ, লিফলেট, বুলেটিন, ঠেকের ভাষা, মুখের ভাষা, চটজলদি প্রতিক্রিয়ার ভাষা – এইসব শব্দ, অক্ষর-বিন্যাসের কারুকাজ আদৌ কোনো কাজে লাগবে ভেবে তৈরি হয় না। কার্যকর হোক বা না হোক, সে সবই আজ এই মুহূর্তে জরুরী। কখনও তা ভেসে উঠে, সৃষ্টি হয়, কখনও তা মুছে যায়, হয়তো লোপাট হয়ে যায়। সব কথা বলা হয় না এখানে। বরং যা থাকে তা ইঙ্গিত, ইশারা মাত্র। দেয়ালের কথা, লেখা, শ্লোগান – নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেই তা রচিত হয়, বিপদের বার্তাই তা বহন করে তার গর্ভে, আতঙ্কের পরিবেশই ঠাই পায় লোক হৃদয়ে। তারপর পথচলিত লোকজনের ছন্দেই তা চলতে শুরু করে, এক হাত থেকে অন্য হাতে। (অক্টোম্বর ১৯৬৮, আন্দোলনের স্বার্থে ছাত্র ও লেখকদের অ্যাকশন কমিটি)

মাও সে তুঙ-এর কথা দিয়ে শেষ করতে চাই-

নির্ভুল সর্বদাই ভুলের সাথে সংগ্রাম করে বিকশিত হয়। সত্য, মঙ্গল ও সুন্দর সব সময়ই মিথ্যা, অমঙ্গল ও কুৎসিতের সঙ্গে তুলনার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় এবং সেগুলো সঙ্গে সংগ্রাম করে প্রসার লাভ করে। মানব সমাজ যখনই কোনো অসত্যকে নাকচ করে দিয়ে কোনো একটা সত্যকে স্বীকার করে নেয় তখনই নতুন সত্য আবার নতুন মিথ্যার বিরুদ্ধে সংগ্রাম আরম্ভ করে। এই সংগ্রাম কোন দিনই শেষ হবে না। সত্যের, এবং মার্কসবাদের বিকাশের এই-ই হল বিধান।

মামুন এলাহী সোহেল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Must Read

Protest against distortion of history in India

ভারতে ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

ইতিহাসের স্রষ্টা হিসেবে বলা হয়ে থাকে হেরোডোটাসকে (খ্রি.পূর্ব ৪৮৪-৪২৫)। তাঁর আগে মানব সমাজের কোনো লিখিত ইতিহাস ছিল না। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১ থেকে ৪০৪ পর্যন্ত প্রাচীন...