Homeমতামত‘পোস্টমাস্টার’ : ভিন্ন দর্পণে

‘পোস্টমাস্টার’ : ভিন্ন দর্পণে

-

বুদ্ধদেব বসু যাকে বলেছিলেন ‘আশ্চর্য বই’ সেই গল্পগুচ্ছ যখন হাতে নেয়া যায়, বিপুল বিস্ময়ে উপলব্ধি করি- ‘দেনা-পাওনা’ থেকে আরম্ভ করে ‘মুসলমানীর গল্প’ অব্দি গমনটা ভারি অনায়াসলব্ধ, সুখপ্রদ। বাহুল্য না থাকলেও, তাঁর গল্পের যে সার্বিক প্রবাহ, সেটি বর্ণনার কিংবা ভাষার; সামান্য রসবোধ সম্পন্ন পাঠকের জন্যও তা থেকে মন ফেরানোটা অসম্ভব। তবে, আজকের আলোচনায় ‘মুসলমানির গল্প’ অব্দি অগ্রসর হতে চাই না। বরং, বিরতি নিতে চাই একেবারেই নিকটে, ‘পোস্টমাস্টার’-এ। গল্পটি হিতবাদী-তে প্রকাশিত হয়েছিল ১২৯৮ সনে। অবশ্য, গল্পের সমাপ্তিতে সাল উল্লেখ করার পর রবীন্দ্রনাথ একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়েছেন। তবে, এ সংশয় তাঁর নিজস্ব; আমাদের আলোচ্য নয়। গল্পটি শিলাইদহে বসে লেখা। তখন সৃষ্টিশীল রবীন্দ্রনাথের অন্যতম ও প্রথম ঊর্বর অধ্যায় অতিবাহিত হচ্ছে। তাঁর ভাঁড়ার ঋদ্ধ হচ্ছে নতুন শস্যে-প্রাণে-সৃষ্টিতে।

গল্পটি সম্পর্কে ‘ছিন্নপত্রে’র স্মরণ নিয়ে জানতে পারি, রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরা দেবীকে লিখেছিলেন : ‘যখন আমাদের কুঠিবাড়ির একতলাতেই পোস্টঅফিস ছিল এবং আমি এঁকে (পোস্টমাস্টার) প্রতিদিন দেখতে পেতুম, তখনি আমি একদিন দুপুরবেলায় এই দোতলায় এসে সেই পোস্টমাস্টারের গল্পটি লিখেছিলুম।’ একজন সাহিত্যিক যত বিপুল সৃজনশীল কল্পনাশক্তির অধিকারীই হোন না কেন; তাঁর গল্পেরও একটা বাস্তব ভূমি থাকে; থাকে অঙ্কুর উৎস। রবীন্দ্রনাথও এই প্রবণতার ব্যতিক্রম নন, নন কল্পনাসর্বস্ব কথক। এত বছর বাদেও তাঁর স্মৃতি কিংবা স্বীকারোক্তি সেটিই জানান দেয়। একই পত্রে এটিও জেনেছি যে- হিতবাদী-তে গল্পটি প্রকাশিত হওয়ার পর সেই পোস্টমাস্টারের কি দারুণ লজ্জারাঙা প্রতিক্রিয়া হয়েছিল।

‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটি যে গ্রামের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে, তার কাঠামোগত পরিচয়, সম্ভবত, গল্পের একটি বাক্যের মাধ্যমেই প্রদান করা সম্ভব : ‘অদূরে একটি পানাপুকুর এবং তাহার চারি পাড়ে জঙ্গল।’ গ্রামের এই অরণ্য-প্রকৃতি এবং পোস্টমাস্টার ও রতনের সম্পর্ক বিবেচনায় নিয়ে, গল্পটিকে অনেকে ‘জীবন ও প্রকৃতি’ বিষয়ক গল্পরূপে বিচার করেছেন। তাঁদের চিন্তাকে আগাগোড়া প্রত্যাখ্যান করছি না। তবে তা বহুলাংশেই খণ্ডিত, সরল এবং একপেশে। বলতে দ্বিধা নেই যে- তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতার কারণেই এমনটা ঘটেছে। ভিন্ন দর্পণে ফেললে দেখবো- গল্পটিতে এই প্রকৃতি কিংবা মানব মনের সমান্তরালে, পূর্ব-বাংলার উনিশ শতকের অন্তে, একটি প্রান্তিক জনপদের সমাজ ও আর্থিক পরিকাঠামোও পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। ডালপালা বিস্তার করেছে; কাজ করেছে চরিত্রগুলোর নিয়ন্ত্রক শক্তির।

উলাপুর গ্রামের প্রকৃতি থেকে মানুষের মনোজীবন সবই অনাধুনিক, আদিমতায় পূর্ণ। যা আর্থিক দিক থেকে ভাঙা, অব্যবস্থিত, অপূর্ণ একটি সমাজের অবভাস গল্পটির প্রতি পরতেই উন্মোচিত করেছে। আরব্য রজনীর দৈত্যের নিকটে গাছপালা কেটে পাকা রাস্তা তৈরি, কিংবা গগণচুম্বী সারি সারি অট্টালিকা তৈরির যে প্রার্থণা ‘কলকাতার জল হতে উলাপুরের ডাঙায় তোলা মাছ’ পোস্টমাস্টারের অহরাত্র ক্ষুন্ন মনে ফুটে উঠতে দেখি, সেটি মূলতঃ এই অব্যবস্থিত প্রতিবেশ থেকে এক নাগরিক ব্যক্তির মুক্তির পথ-অনুসন্ধান ব্যতিরেকে আর কিছুই নয়। রতনের গুরুত্বটা, অস্তিত্বটা সেখানে কোনভাবেই অনিবার্য ছিল না। যে কারণে শেষ অব্দি নিজের এই অতি প্রয়োজনীয় চাকুরিটিও ছেড়ে দিতে পোস্টমাস্টার দ্বিধাবোধ করেন না।

প্রথমে পোস্টমাস্টারের আর্থিক অবস্থাটা বিবেচনা করে দেখতে পারি। তিনি রবীন্দ্রনাথের, বিশেষত গল্পগুচ্ছ-র আরও বহু নায়কের মতো কলকাতার পাশ করা যুবক হলেও, তাদের তুল্য ভাগ্যবান নন। উলাপুরে চাকুরি করতে এসেছেন নেহাতই পেটের দায়ে। গল্পকার রবীন্দ্রনাথ এটিও গোপন রাখেননি যে- পোস্টমাস্টারের মাইনেটাও উলাপুর গ্রামের মতোই সামান্য। এর মাধ্যমে পোস্টমাস্টারের দারিদ্র্য, অভাবী জীবন সম্পর্কেও পুরোদস্তুর নিঃসন্দেহ হতে পারি। ভাবি, এই যদি না হবে তবে- উলাপুরের তুল্য গণ্ডগ্রামে, যেখানে তার প্রাণ সদা ওষ্ঠাগত, কেই বা সাধ করে চাকুরি করতে আসে, বসবাস করে? দু’এক স্থানে কলকাতার কোন অনুন্নত পাড়ার, ঘিঞ্জি গলিতে বাস করা, মাসের অন্তে একটি মানি অর্ডারের জন্য অপেক্ষারত তার বিধবা মা, ভাই এবং বোনের ছবিটিও মানসে অজান্তেই ভেসে ওঠে। সহানুভূতি তৈরি করে।

পোস্টমাস্টারের এই অবস্থার বাইরে উলাপুর গ্রামে যে মানুষদের বসবাস, সামান্য খেয়াল করলেই দেখা যাবে- তারা আদতে কোন গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠী নয়। গ্রামের পাশে নীলকুঠির প্রয়োজনে একটি পোস্টঅফিস স্থাপিত না হওয়া অবধি তারা ছিল সার্বিকভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এমনকি কোন শিক্ষিত মানুষের বাসও গ্রামটিতে নেই। কারণ হিসেবে দেখতে পারি- গল্প করার মতো উপযুক্ত; কিংবা নিজ রুচির অনুগামী কোন শিক্ষিত মানুষ পায়নি বলেই, পোস্টমাস্টারকে রতনের তুল্য এক অশিক্ষিত বালিকার সঙ্গে গল্প করে, বহু দুপুরের ক্লান্তিকর ব্যাপ্তি অতিবাহিত করতে হয়েছিল।

অবকাঠামোগত দিক থেকেও উলাপুর গ্রামটি একেবারেই পিছিয়ে রয়েছে। পূর্বে পানাপুকুর আর জঙ্গলের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছি; গল্পের বিবরণে আরও পাই- পোস্টমাস্টার কাজ করে একটি অন্ধকার আটচালার মধ্যে। কেবলমাত্র একটি সরকারি অফিসেরই নয়, সমান্তরালে উলাপুর গ্রামের অবকাঠামোগত দীনতাও এর মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এমন একটি গ্রামের মানুষেরা যে অর্থনৈতিকভাবে খুব একটা স্বাবলম্বী হবেন না- এই দিকটিও ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে একবারে গোপন থাকেনি। বালিকা রতন পোস্টমাস্টারের চব্বিশ ঘণ্টার বাঁধা কাজের লোক। সে পোস্টমাস্টারের জন্য রান্না করে, বিভিন্ন ফরমায়েশ খাটে। পোস্টমাস্টার আসে পোস্টমাস্টার যায়- কিন্তু রতনের কাজের বদল হয় না। পরিবর্তন হয় না ভাগ্যেরও; সে যেন দুর্নীতিগ্রস্ত কোন রাষ্ট্রের ভাগ্যাহত নাগরিক। এর সামাজিক কারণ খুঁজলে দেখা যাবে রতন দরিদ্র। তার বাবা-মা নেই, একারণে বিয়েরও কোন গতি নেই। আবার, পোস্টমাস্টারের নিকটে রতন ছোটবেলার যে সামান্য পারিবারিক স্মৃতিচারণ করে, সেখান থেকেও অনুধাবন করা যায় বাবা-মা জীবিত থাকতেও তার জীবন দারিদ্র্যের মধ্যেই অতিবাহিত হয়েছে। রতনের একটি বাক্যেই তাদের আর্থিক অবস্থা পরিষ্কার হয়ে ওঠে- ‘পরিশ্রম করিয়া বাপ সন্ধ্যাবেলায় ঘরে ফিরিয়া আসিত।’ উপলব্ধি করতে মোটেও সময় লাগে না যে- রতনের বলা এই পরিশ্রম, আদতে কায়িক পরিশ্রম; শ্রমিকের বৃত্তি। এর মাধ্যম শুধু রতনের বাবারই নয়; বরং, সঙ্গে উলাপুরের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশের আর্থিক সংস্থিতি সম্পর্কেও সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়; তাদের নড়বড়ে অবস্থাটা অনুমান, কল্পনা করা যায়।

গল্পগুচ্ছ-র পরিচিত নায়িকাদের তুল্যই রতনের বয়স বারো-তেরো। এই বয়সেই গল্পকার আশা ছেড়ে দিয়েছেন যে- তার আর বিয়ে হবে না। আদতে, এটি রবীন্দ্রনাথেরও বক্তব্য নয়। সমাজের কথা, বক্তব্য; আচরিত প্রথা, ধর্ম। কারণ, রতন যে সমাজে বাস করে, কারুর বিয়ে হলে সেখানে দশ-বারো বছরেই হয়। নইলে আর হয় না; সে পায় এক অপচয়িত নারীর তকমা, জীবন। সমাজের এই দিকটা ধরে বিবেচনা করলে- ‘দেনা-পাওনা’র নিরুপমার পরই গল্পগুচ্ছে বর্ণিত অনুশাসন সর্বস্ব ব্যবস্থার আরেক বলি ‘পোস্টমাস্টারে’র রতন। মৃত্যু পতিগৃহে শত-নিগৃহীতা নিরুপমাকে মুক্তি দিয়েছিল। কিন্তু, পোস্টমাস্টারদের পুরুষানুক্রমিক বাঁধা দাসী রতনের কোন মুক্তি নেই। গতি নেই। বরং, সে যেন খানিকটা জীবন্মৃত; একটা ফেলনা; একটা অপচয়।

‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে পোস্টমাস্টার পদটির, পেশাটির এক ভয়ানক গ্রাসশক্তি রয়েছে, এটি যেন এক সক্রিয় চোরাবালি; যাকে বিবেচনা করতে পারি পেশার সর্বগ্রাসিতা রূপেও। অর্থাৎ, পোস্টমাস্টারের পেশাগত পরিচয়ের নিচে হারিয়ে গেছে তার ব্যক্তি পরিচয়। পোস্টমাস্টারের যে পরিচয় রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন; তাতে দেখা যায়- সে কলকাতা থেকে আসা এক যুবক, তার রতন নামের একজন বাঁধা কাজের মেয়ে রয়েছে; কলকাতায় রয়েছে তার উপর নির্ভরশীল মা, বোন এবং ছোটভাই। কিন্তু, পোস্টমাস্টার নিজে কে? তার কি আছে কোন নাম? এই প্রশ্নগুলোর সদুত্তর অনুপস্থিত। আর, পোস্টমাস্টার যে সমাজে বসবাস করে, সেখানেও তার নামটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং, গুরুত্ব বহন করে পেশাগত পরিচয়, তকমা। এক্ষেত্রে, নামহীন পোস্টমাস্টারকে রতনের থেকেও ভাগ্যহত বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। কাজের লোক রতনেরও একটি নাম রয়েছে, কিন্তু পোস্টমাস্টারের সেটিও নেই।

কাজের লোক পরিচয়ের বাইরে; ‘রতন’ এই নামটি গল্পটিকে কেবল পোস্টমাস্টারের গল্পেই সীমাবদ্ধ রাখে না; চ্যালেঞ্জ জানায়, একটা আলাদা জায়গা তৈরি করে; করে তোলে রতনেরও গল্প। এ প্রসঙ্গে পোস্টমাস্টারের সঙ্গে রতনের সম্পর্কটি খতিয়ে দেখা যেতে পারে। এখানেও মূল অনুঘটকের কাজ করেছে সমাজ এবং আর্থিক অবস্থান। দেখি- তাদের মধ্যে যে আন্তরিক সম্পর্ক; সেখানে কলকাতার শিক্ষিত যুবক পোস্টমাস্টার নিজের দূরত্ব বজায় রাখতে পারে। এর পেছনে ক্রিয়াশীল আছে তার শিক্ষা, পারিবার ও শহুরে সামাজিক অবস্থান। কিন্তু, অল্পবয়স্কা, অনাথ, গ্রামীণ বালিকা রতন সেটি পারে না; ব্যর্থ হয়। একারণে- গল্প শুনতে শুনতেই পোস্টমাস্টারের বাড়ির নিকট পরিজনরা রতনের মা, দাদা ও দিদি হয়ে ওঠে। সেও নিজেকে তাদেরই একজন কল্পনা করতে আরম্ভ করে; তার কল্পনার জগৎটা কখনো কখনো ভৃত্য থেকে ভগ্নীর দ্বারে গিয়ে উপনীত হয়। পোস্টমাস্টারের জন্যও রতনের হৃদয়ে জন্মে, তারই মতো ক্ষুদ্র এক ভালোবাসার মাটি ফুঁড়ে বেরুবার চেষ্টা। যার তুচ্ছতা, গ্রাম্যতা, আরণ্যিকতা পোস্টমাস্টারের মনে কোন আবেদন জাগাতে পারেনি; অন্তত তার মনোভাবে এটা আমরা প্রত্যক্ষ করি না। গল্পের সমাপ্তিতে- রতনের মাতৃসম সেবায় জ্বর থেকে সেরে ওঠার পর উলাপুরের চাকুরি ছেড়ে পোস্টমাস্টার চলে যাবার উদ্যোগ নেয়। সঙ্গে কলকাতায় নিয়ে যাবার প্রস্তাবে রতনকে বলে- ‘সে কি করে হবে।’ পোস্টমাস্টার চলে যায়, আহত রতন পড়ে থাকে। দেখি- চলে যাবার পূর্বে পোস্টমাস্টারের দেয়া টাকা, কিংবা ভাবীকালের পোস্টমাস্টারের নিকটে তার দায়িত্ব দিয়ে যাবার দয়া রতন প্রত্যাখ্যান করে। ‘আমাকে কিছু দিতে হবে না; তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমার জন্য কাউকে কিছু ভাবতে হবে না’- বিনয়, আবেগ ও তীব্র ব্যথা-অভিমান মিশ্রিত এ প্রত্যাখ্যান রতনকে হঠাৎ যেন মেরুদণ্ডী করে তোলে। মাত্র আড়াই পৃষ্ঠার একটা গল্পে সে অর্জন করে ট্রাজেডির অপরাজেয় নায়িকার মহিমা।

এরপরে, রবীন্দ্রনাথ পোস্ট অফিসের চারপাশে ঘুরে ঘুরে রতনের কান্নার যে বিবরণ দিয়েছেন, রতনের বয়সকে বিবেচনার বাইরে রাখলে, তা আদতে পাঠযোগ্য মনে হয় না। এই বর্ণনা তাকে বরং খানিকটা খাটো করেছে। রতনের আবদারের পরও পোস্টমাস্টারের তাকে ফেলে যাবার পশ্চাতে দুটি কারণ ক্রিয়াশীল থাকতে দেখি : প্রথমত, রতন এক গ্রাম্য, অনাথ বালিকা; তাকে হয়তো বেতনের সামান্য টাকাটা উদারতা দেখিয়ে হাতে ধরিয়ে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু, কলকাতায় নিয়ে যাওয়া যায় না। সে উলাপুরেই বেশি মানানসই, তার জায়গা এটাই। পোস্টমাস্টারের নাগরিক মনে এই ভাবনা কাজ করেছে। দ্বিতীয়ত, পোস্টমাস্টার নেহাতই দরিদ্র; যার দরুণ এই গণ্ডগ্রাম উলাপুরে চাকুরি করতে এসেছিলেন, সেটিও ছেড়ে এখন বেকার। আবার, তার ঘরেই রয়েছে তিনজন পোষ্য। এই রতনের জন্য, যতই সে কাজ করে খাক, অন্নসংস্থানের উপায় কি সত্যিই তার আছে যে তাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলবে? বলাই বাহুল্য- এই দারিদ্র্যতাও পোস্টমাস্টারকে বাধ্য করেছে রতনকে ফেলে চলে যেতে। হৃদয়হীন হতে। এই রূঢ় সামাজিক এবং আর্থিক বাস্তবতার সমুখে রবীন্দ্রনাথের ‘ফিরিয়া ফল কি। পৃথিবীতে কে কাহার।’ তত্ত্ব নেহাতই জলো হয়ে ওঠে; বিপুল আবেগমথিত পরিচিত ক্রিয়াশীলতা হারিয়ে ফেলে।

দমবন্ধ করা, আরণ্যক উলাপুর পোস্টমাস্টারকে মুক্তি দেয়, প্রয়োজন হয় না আরব্য রজনীর কোন দৈত্যের। মুক্তি দেয় অবলম্বনহীন, ক্ষুদ্র, দরিদ্র, বিজয়ী বালিকা রতনও। কিন্তু, সত্যিই কি মুক্তি মেলে পোস্টমাস্টারের? না, বরং- তার পেছনে লেপ্টে থাকতে দেখি দারিদ্র্য আর জীবনের পুঞ্জ পুঞ্জ সীমাবদ্ধতা। ক্রিয়াশীল মস্তিষ্কে প্রশ্ন জাগে- এগুলো তাকে মুক্তি দেবে কি? রাখঢাক না রেখেই বলি, একারণে- নদীতে, পালে হাওয়া লাগা নৌকায়, কলকাতার পথে ধাবমান যুবক পোস্টমাস্টারের মধ্যে ক্রমশ এক পরাজিত মানবের ছবি পরিকাঠামো পায়। বেশ বোঝা যায়- ভবিষ্যতে, সামনের দিনগুলোতে এভাবে তাকে আরও পালাতে হবে, ছুটতে হবে। ছুটতে হবে বহু উলাপুর ছেড়ে; বহু রতনকে ছেড়ে। তার মুক্তি নেই; সে একটা জালে আটকে গেছে। সেটি ব্যবস্থার জাল। এটুকু বলার- এই জাল কাটাবার দায় কেবল একা পোস্টমাস্টারের নয়। আরও অনেকেরই; সমষ্টির।

নাজমুল হাসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Must Read

Rice seed conservation is the farmer's right

ধান বীজ সংরক্ষণ কৃষকের অধিকার

পৃথিবীর মানচিত্রে একটা খুবই ছোট দেশ হল বাংলাদেশ। নদী অববাহিকার দেশটা ছোট হলেও জীববৈচিত্র্যে অসাধারণ। ধানের প্রাচীনত্ব, পুষ্টি ও ভেষজ গুন সম্পন্ন ধানের স্থানীয়...