Homeমতামতছায়াপথ পাঠ-প্রতিক্রিয়া

ছায়াপথ পাঠ-প্রতিক্রিয়া

-

বাংলা সাহিত্যের শীর্ষস্থানীয় উপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর রচিত হাসুলিবাঁকের উপকথা, কালিন্দি, গণদেবতা, কবি ইত্যাদি উপন্যাসের তুল্য উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে বিরল বলা যায়। গ্রাম সমাজই ছিল তাঁর মূল মনোযোগের বিষয়। গ্রামীণ সমাজের ভাঙন সামন্তীয় মূল্যবোধ এবং আবহমানকালের সামাজিক সংস্কৃতির সাথে পুঁজিতান্ত্রিক সমাজবোধের সংঘাত ইত্যাদি বিষয় সততার সাথে তিনি রূপায়ণ করেছেন। অতীত প্রীতি তাঁর ছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু নতুনের উত্থানকে তিনি অবমূল্যায়ন করেননি। এখানেই ছিল তাঁর সততা, দূরদর্শিতাও। তারাশঙ্কর ঐতিহাসিক উপন্যাসও লিখেছেন। ঐতিহাসিক উপন্যাসের স্থান-কাল-পাত্রকে অবিকৃত রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন আবার সাহিত্য বিবেচনায় তাঁকে কল্পনার আশ্রয়ও নিতে হয়েছে। গন্নাবেগম, অরণ্যবহ্নি, তাঁর রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাস। তবে তাঁর রচিত উপন্যাস ছায়াপথ শুধু সর্ববৃহৎ ঐতিহাসিক উপন্যাসই না, এ ধারার সর্বশ্রেষ্ঠও বলা যায়। ভারতবর্ষের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ সপ্তদশ শতাব্দীর শাসনতান্ত্রিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁর এই উপন্যাস। একটা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রশ্নকে তিনি সামনে এনেছেন। নানা দিক থেকে সেই প্রশ্নের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। কোনো সমাধানের পথ যে তিনি দেখাতে পেরেছেন এমন না, যে কারণে উপন্যাসের সমাপ্তিতে তাঁকে বিয়োগান্ত ঘটনার আশ্রয় নিতে হয়েছে। ঐতিহাসিক উপন্যাসের সীমা ঐতিহাসিক ঘটনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই বাস্তবতার মধ্যেই লেখক তাঁর কল্পনার ডানা বিস্তার করেন, ঘটনাকে অতিক্রম করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না।

ভারতবর্ষে সম্রাট সাহজাহানের রাজত্বের তখন শেষ পর্ব। তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজ মহলের মৃত্যু হয়েছে। আরও দুজন স্ত্রী যদিও জীবিত কিন্তু প্রাসাদে তাঁদের তেমন গুরুত্ব নেই। সম্রাটের মেয়ে তিনজন। তারমধ্যে জাহানারা, রৌশনারা বিদুষী। কিন্তু প্রাসাদে ক্ষমতাধর জাহানারা, সম্রাটের প্রিয়জনও সে। সম্রাটের চার পুত্র – দারা শিকো, সুজা, আওরঙ্গজেব, মুরাদ। এঁদের মধ্যে দারা শিকো সম্রাটের বিশেষ পছন্দের, তাঁকে সম্রাট রেখেছেন নিজের কাছে। অন্যদেরকে পাঠিয়েছেন বিভিন্ন প্রদেশে সুবেদারের দায়িত্বে। সবচেয়ে গোলমেলে দূরবর্তী দক্ষিণে সুবেদার করেছেন আওরঙ্গজেবকে। সে সাহসী, ধর্মভীরু আর কৌশলীও। সম্রাট তাঁকে বিশেষভাবে গণ্য করেন, অস্বস্তিও বোধ করেন তাঁকে নিয়ে, কেননা সম্রাটের প্রতি আনুগত্যের ক্ষেত্রে তাঁকে খুব বিশ্বস্ত মনে হয় না।

ভারতবর্ষ বহু ধর্ম বহু বর্ণের দেশ। হিন্দু ধর্মই প্রধান তারপর মুসলমান ধর্ম। হিন্দু ধর্মের প্রতি দারা শিকো’র আগ্রহ। হিন্দু ধর্মের প্রাচীন বইগুলো অনুবাদ করার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি, নিজে চর্চাও করেন। অপরদিকে আওরঙ্গজেব ইসলাম ধর্মের সুন্নি মতাবলম্বী। গোড়া, রসুলের অনুসারী। ধর্ম নিয়ে তাঁর মধ্যে কোনো প্রশ্ন নেই, বিভ্রান্তিও নেই। রসুলের পথ অনুসরণই তাঁর ঘোষিত লক্ষ। অপর দুই ভাই সুজা আর মুরাদ। সুজা সাহসী, ক্ষমতার লিপ্সা তাঁর আছে কিন্তু কৌশলী না। মুরাদ রিপু তাড়িত মানুষ।

সম্রাটের সাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি রাজ্য চালানোর নির্বাহী ক্ষমতা অর্পণ করেন দারার উপর। এই সিদ্ধান্ত অপর তিন ভাই মানতে পারে না। শুরু হয় ভ্রাতৃবিরোধ। যে বিরোধ সাম্রাজ্যের ভেতর রক্ত বন্যা বইয়ে দেয়। ভ্রাতৃবিরোধ বা ভ্রাতৃ হত্যা মোগল সম্রাটদের জন্য নতুন ঘটনা না। সম্রাট হুমায়ূন থেকে শুরু করে আওরঙ্গজেব পর্যন্ত প্রত্যেকের হাতই ভ্রাতৃরক্তে রঞ্জিত হয়েছে। কিন্তু সাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে যে বিরোধ, বিশেষত দারা আর আওরঙ্গজেবের মধ্যে, সেই বিরোধের কারণ শুধুমাত্র ক্ষমতা দখল ছিল না। সেই বিরোধের পেছনে আদর্শগত কারণও ছিল। দারার প্রতি স্বয়ং সম্রাটের প্রত্যক্ষ সমর্থন ছিল, সাথে ছিল রাজকীয় বাহিনীর প্রায় সবটাই। দারা নিজেও যুদ্ধে পারদর্শী ছিলেন। তারপরও সমুগড়ের যুদ্ধে আওরঙ্গজেবের কাছে তাঁর পরাজয় ঘটে গেল। এই পরাজয়ের পেছনে ছিল আওরঙ্গজেবের রণকৌশল আর মনোবল। বিচারে দারার মৃত্যুদণ্ড হলো আর আফগানিস্তান থেকে ভারতবর্ষ পর্যন্ত বিপুল সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি সম্রাট সাহজাহানকে কারাবন্দী হতে হলো। জীবনের বাকি আট বছর তাঁর কাটলো বন্দিদশাতেই।

কিন্তু এইসব ঘটনার চাঞ্চল্য বা উত্তেজনার ব্যাপারে লেখকের তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। তাঁর আগ্রহ দেখা যায় দারা শিকো আর আওরঙ্গজেবের আদর্শগত বিরোধের জায়গায় এবং এই জায়গাটা স্পষ্ট করার জন্য তাঁকে যেমন দরবারী সংস্কৃতিকে জানতে হয় তেমন অনুপুঙ্খ জানতে হয় তৎকালীন ভারতীয় মানস।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে ভারতবর্ষ বহু ধর্ম বহু বর্ণের দেশ। সেখানে মোগল সম্রাটদের মধ্যে সবচেয়ে সফল সম্রাট – রাজ্য বিস্তারে যেমন, রাজ্যে শান্তি স্থাপনে তেমন, সম্রাট আকবর – ধর্ম-বর্ণ-জাত-পাতের দ্বন্দ্ব মীমাংসায় সব ধর্ম সমন্বয়ে এক নতুন ধর্ম দীন-ই-এলাহী প্রবর্তন করতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনি সফল হননি বরং প্রাসাদের ভেতর এবং বাইরে হিন্দু মুসলমানরা আকবরের এই চেষ্টাকে নিজেদের ধর্মের উপর আঘাত হিসেবে সাব্যস্ত করেছিল। সম্রাটের সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং নির্ভরযোগ্য সেনাপতি মানসিংহও এ ব্যাপারে উৎসাহী ছিল না। সম্রাটের জীবদ্দশাতেই দীন-ই-এলাহী ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছিল। সম্রাট জাহাঙ্গীর বা সাহজাহান এ জাতীয় কোনো চিন্তায় উৎসাহী ছিলেন না। তাঁরা ইসলামের সুন্নি মতকে স্বাভাবিকভাবে ধারণ করেছিল। সাহজাহানের রাজত্বকালে সম্রাটের এক ধর্ম বিষয়ক ফরমান রাজ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। তিনি দ্বৈত ধর্মে বিবাহ নিষিদ্ধ করেছিলেন। অর্থাৎ বিবাহ হবে সমধর্মে, প্রয়োজনে ধর্মান্তরিত হতে হবে। পূর্বে এই বিধান ছিল না। সম্রাট আকবরের একাধিক স্ত্রী ছিল ভিন্ন ধর্মাবলম্বী।

দারা শিকোর ছিল বিভিন্ন ধর্ম প্রীতি, বিশেষত হিন্দু ধর্ম। তাঁকে সম্রাট আকবরের অনুসারী বলে মনে করা হত, যার ফলে মুসলমানরা যেমন তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট ছিল না, তেমন হিন্দুরাও মনে করতো দারা শিকোর দ্বারা তাঁদের ধর্মও বিপদগ্রস্ত হবে। দারা শিকোকে নিয়ে আর একটা প্রশ্নও উঠেছিল। মানব কল্যাণে তিনি যদি কোনো নতুন ধর্মেরই প্রবর্তন করতে ইচ্ছুক তবে তাঁর অবস্থান প্রাসাদে কেন? ধর্ম প্রচারকরা সবসময়ই ছিলেন সর্বস্বত্যাগী, দারা কেন প্রাসাদ ত্যাগ করতে পারছে না? কিন্তু আসলেই দারা কি সম্রাট আকবরের মতো কোনো নতুন ধর্ম প্রবর্তনে ইচ্ছুক ছিলেন? নাকি সবই ছিল বিরুদ্ধবাদীদের প্রচারণা? ইতিহাসে এ এক অমীমাংসিত প্রশ্ন। তবে সব ধর্মের সার সংকলনে দারার যে আগ্রহ ছিল সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। পক্ষান্তরে আওরঙ্গজেবকে নিয়ে মুসলমান বা হিন্দু কারো মধ্যেই এ ধরনের কোনো বিভ্রান্তি ছিল না। তাঁর ধর্মীয় দৃষ্টি ভঙ্গি শুধু স্বচ্ছ ছিল না, ধর্মের প্রতি তাঁর নিষ্ঠাও ছিল চরম। মদ-নারী-ভোগবিলাস ইত্যাদি যা ছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের সহজাত, আওরঙ্গজেব এসব থেকে নিজেকে পরিহার করেছিলেন এবং জীবনযাপন করতেন সাধারণ মানুষের মতো।

আওরঙ্গজেব প্রাসাদে এবং প্রসাদের বাইরেও মানুষজনদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং নিজেও বিশ্বাস করতেন যে দারা ক্ষমতায় গেলে ভারতবর্ষে ইসলাম বিপন্ন হবে। অন্যদিকে ক্ষমতারোহণের জন্য দারার ভরসা ছিল সম্রাটের সমর্থন। সেই সমর্থন তিনি দিয়েছিলেনও। বহুমাত্রিক ভারতবর্ষে উদারপন্থী সম্রাট সাহজাহান সম্ভবত আওরঙ্গজেবের কট্টর ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে উপযুক্ত মনে করতেন না।

এই বিশাল ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রেক্ষাপট উপরোক্ত প্রাসাদ রাজনীতির হলাহল হলেও লেখকের দৃষ্টি ছিল অন্য জায়গায়। বহু ধর্ম জাত-পাতের ভারতবর্ষে ঐক্যের সূত্র কোথায়, মানুষের জীবনের চূড়ান্ত আরদ্ধই বা কী, ঘটনার জটজালের মধ্যে সেটাই ছিল তাঁর অনুসন্ধানের বিষয়।

লেখক মহম্মদ সৈয়দ ওরফে হজরত সারমাদ নামক এক আধ্যাত্মিক সাধককে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রে স্থাপন করেছেন। ইতিহাসে হজরত সারমাদের ন্যূন পরিচয় মেলে। হজরত সারমাদ প্রথম জীবনে ছিলেন আর্মানী ইহুদী। ধর্মে মতি ছিল তাঁর। পিতা ছিল ব্যবসায়ী। ২০ বছর বয়সে তিনি কোরান পড়তে শুরু করেন এবং ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। অতঃপর মক্কায় যেয়ে ধর্ম শাস্ত্রে বুৎপত্তি অর্জন করেন। মক্কা থেকে দেশে ফিরে তিনি দেখেন আত্মীয় স্বজনরা তাঁকে পরিত্যাগ করেছে, ব্যবসাও ধ্বংস হয়েছে। নতুনভাবে তিনি ব্যবসা শুরু করেন এবং নানা ধরনের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন। এই সময় তিনি সলিমা নামে এক ভারতীয় সিন্ধী-হিন্দু ঘরের মেয়ের প্রেমে পড়েন। সলিমার জীবন ইতিহাস ছিল বিচিত্র। পাঁচ বছর বয়সে তাঁকে করাচীর গোলামের হাটে বিক্রি করে ইরানে নেওয়া হয়। সেখানে এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী তাঁকে ক্রয় করে।

অতঃপর ব্যবসায়ী মারা গেলে ব্যবসায়ীর স্ত্রী নিজের মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য যাচ্ছিলেন সিরাজ থেকে ইস্পাহান। সেখানে সলিমাকে বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করাও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। পথে ঘটনাক্রমে মহম্মদ সৈয়দের সাথে সলিমার পরিচয় হলে তিনি মোহিত হয়ে পড়েন। কিন্তু তিনি তখন কপর্দক শূন্য। সওদাগর পত্নীর কাছে তিনি দুই বছর সময় চেয়ে নেন। ইতিমধ্যে রত্নের ব্যবসা করে মহম্মদ সৈয়দ বিপুল খ্যাতি আর সম্পদ অর্জন করেন কিন্তু চার বছর পর খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন সলিমা বিক্রি হয়ে নিরুদ্দেশে গেছে। এই সময় বছর পাঁচেকের এক বালক, সলিমার ভাই, অভয়চান্দের মধ্যে তিনি সলিমার প্রতিচ্ছায়া দেখতে পান। অতঃপর অভয়চান্দই হয়ে ওঠে মহম্মদ সৈয়দের আধ্যাত্মিক সাধনার মূল কেন্দ্র।

অভয়চান্দ হিন্দু না, মুসলমান বা খ্রিস্টান না, নারী না, পুরুষও না, সে যেন সর্বজনীন এক প্রেমের প্রতীক। এদিকে মহম্মদ সৈয়দের কাছে যাবতীয় ইহলৌকিকতা অর্থহীন হয়ে ওঠে, এমনকি কি তিনি নিজের পোষাক পরিচ্ছদও বর্জন করে ফেলেন, হয়ে ওঠেন আধ্যাত্মিক সাধক হজরত সারমাদ। অভয়চান্দকে কেন্দ্র করে জমে ওঠে হজরত সারমাদের মজলিশ। অভয়চান্দ গান গায়, নাচে আর এই নাচ-গানের মধ্যে অনেক সময় তাঁর ভাব-সমাধি হয় (এই ভাব-সমাধি পাঠককে ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথা মনে করিয়ে দেয়)। ভাব-সমাধিকালে অভয়চান্দের মধ্যে নানা ধরনের আধ্যাত্মিক বোধের উদ্ভব হয়। সেই আধ্যাত্মিক বোধের ব্যাখ্যা হয় কখনও কথায়, কখনও গানে।

জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যে সর্বজনীন প্রেমের বাণী হজরত সারমাদ প্রচার করতে থাকেন শাহজাদা দারা তাতে উৎসাহী হবেন সেটাই স্বাভাবিক। সারমাদের সাথে দারা শিকো’র সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। জনগণের মনেও এই প্রশ্ন ঘনীভূত হয় – দারা ক্ষমতায় গেলে ইসলাম কি বিপন্ন হবে? হিন্দু ধর্ম কি তার মৌলিক ঠাটকে বজায় রাখতে পারবে?

ধর্মীয় বিভেদের প্রতিক্রিয়াকে স্পষ্ট করার জন্যই যেন লেখক আরও দুটো চরিত্রের অবতারণা করেন – বিখ্যাত কবি সুভগ ও শিরিন। সুভগ হিন্দু, ঘটনাক্রমে শিরিন মুসলমান। নিজ ধর্মের প্রতি অনুরাগ দুজনেরই। সম্রাট সাহজাহানের ফরমান অনুযয়ী যেহেতু সমধর্ম ছাড়া বিবাহ নিষিদ্ধ সেহেতু তাঁদের প্রেম চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করতে পারে না। দারা শিকো ক্ষমতায় গেলে তাঁদের প্রেম পরিণতি লাভ করবে এই আশা তাঁরা যেমন করেন তেমন দারা শিকোও সুভগ শিরিনের বিবাহের মাধ্যমে তাঁর ধর্মীয় নীতির প্রকাশ ঘটাতে চান।

যুদ্ধে দারা পরাজিত হলে বিচারে সারমাদের মৃত্যুদণ্ড হয়। হাজার হাজার জনতার সামনে তাঁকে ধরে আনা হয়। তাঁর এক সময়ের পরিচিত বাউন্ডুলে সুলেমান তখন জল্লাদ। জল্লাদের ছুরির তলায় দাঁড়িয়ে সারমাদ যেন উপলদ্ধি করেন মৃত্যুই জীবনের সমাপ্তি না। তিনি বলেন, ‘সুলেমান, তুমি জন্ম জন্মান্তরে আমার পেছনে আছ, শাহজাদা দারার পেছনে আছ। বার বার আমাকে তুমি হত্যা করেছ। তুমি আমার পরম মিত্র। বার বারই এইভাবে তোমার উদ্যত খড়্গরে মধ্য থেকে বেরিয়ে এসে সামনে দাঁড়িয়েছ আমার পরম কামনার ধন পরম তপস্যার দেবতা।’

মাত্র একটি বাক্যে সারমাদের হত্যার ঘটনাটি যেভাবে লেখক মূর্ত করেছেন পরিমিতি আর ব্যঞ্জনার দিক থেকে তার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। ‘সুলেমানের খড়্গ তার দুই হাতের আস্ফালনে রৌদ্রদীপ্ত শূন্যমণ্ডলে একবার ঝলকে উঠল’।

‘এদিকে দিল্লীর এক প্রান্তে একটি স্থানে একটি গাছের তলায় একটি সুকুমার তনুদেহ পড়েছিল,

দেহটি অভয়চান্দের। তখন তাঁর ঠোঁট দুটি নড়ছিল।

অস্ফুট কণ্ঠে বলছিল- ফকির, তোমার ডাকে আমার ঘুম ভেঙেছিল। হায় কেন ঘুম ভাঙালে? এতো দেখি হিংসা আর বিদ্বেষ। মানুষ গর্জন করছে জানোয়ারের মতো। আমি চোখ বুজলাম ফকির-তুমি চোখ বোজো-আসবে সময়। আসবে। সেদিন আসবে। তবে অনেক দেরি আছে। অনেক রক্তস্রোতে দুনিয়া ভাসবে – অনেক মুণ্ডু ভেসে যাবে। সারমাদ। মনে হবে যে দিন আমরা চেয়েছিলাম সেদিন আর আসবে না। না। আসবে। আসবে? এখন হলো না – না হোক – এখন ঘুমাও। আমার সেই হারিয়ে যাওয়া বাঁদি বহেন – সেও চোখ বুজলো তুর্কীস্তানে। আমিও চোখ বুজব। তুমি ঘুমোও।

স্তদ্ধ হয়ে গেল অভয়চান্দ।’

অভয়চান্দের কাঙ্খিত যে দিন সে কোন দিন? হিংসা বিদ্বেষ বর্জিত প্রেমময় শান্তির এক দিন। এই দিনের প্রত্যাশাতেই সারা উপন্যাস জুড়ে প্রথমে মহম্মদ সৈয়দ অতঃপর হজরত সারমাদের গড়ে ওঠা। বিরাট পটভূমিতে অসংখ্য চরিত্রের সমন্বয়ে রচিত হয়েছে এই উপন্যাস। ফারসি ও উর্দু শায়েরের ব্যবহার হয়েছে বিভিন্ন প্রসঙ্গে, বলা বাহুল্য, ফার্সি বা উর্দু না জানা পাঠকদের পক্ষে তার অর্থ উদ্ধার সম্ভব না। অর্থ জানানো যে লেখকের উদ্দেশ্য এমনও মনে হয় না। আসলে এই সব শায়ের ব্যবহার হয়েছে কাহিনীর সৌন্দর্য বর্ধনে। সপ্তদশ শতকের শাসক শ্রেণীর সাংস্কৃতিক পরিচয়, সে দিল্লী বা আগ্রার প্রাসাদের যেমন তেমন ভারতের দূরবর্তী অঞ্চলেরও, এই উপন্যাসে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ঐতিহাসিক পাত্র পাত্রীর পরিচয়, ঘটনা প্রায় অবিকৃতভাবে এসেছে। ভারত আর আফগানস্তানের কিছুটা জুড়ে বিশাল মোগল সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপণাও উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। এ সব কিছুই লেখকের অপরিসীম পরিশ্রমের সাক্ষ্য বহণ করে। লেখকের অসাধারণ শৈল্পিক দক্ষতা পুরো বিষয়টাকে এতবেশি জীবন্ত করে তোলে যেন পাঠকও ঐ সময়ের একজন প্রতিনিধি হয়ে যায়।

গোটা উপন্যাসটি ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বা হিন্দু মুসলমানের দ্বন্দ্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। লেখকের স্বার্থকতা এই যে উপন্যাসটিকে তিনি একটি আদর্শিক সংঘাতের জায়গায় দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন। দারা শিকো বা আওরঙ্গজেব কারো প্রতিই লেখকের কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই। তিনি যেন নির্বাক দর্শক মাত্র। শেষ পর্যন্ত অভয়চান্দের আশাবাদই বিরাণ প্রান্তরে ম্রিয়মাণ আলোক বর্তিকার মতো দীপ্যমান থাকে।

আসলে উপন্যাসটির ব্যাপক কলেবর আর ঘটনাকালের বিস্তৃতি থাকলেও তখনকার সাধারণ মানষুজনের পরিচয় তেমন নেই বলা যায়। রাজন্যবর্গের নিজেদের দ্বন্দ্ব বিরোধ, কখনও আধিপত্যের প্রশ্নে, কখনও ধর্মীয় প্রশ্নে, উপন্যাসের মূল উপজীব্য হয়ে থাকে। হজরত সারমাদের ভক্তরা সাধারণ মানুষ। রাজন্যবর্গের মধ্যে দারা শিকোও তাঁর ভক্ত কিন্তু এই ভক্তি একান্তই মারফতি ব্যাপার। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের সাথে এই ভক্তির কোনো সম্পর্ক নেই। মোগল শাসকরা সুশাসক ছিলেন হয়তো। এক চিঠিতে আওরঙ্গজেব তাঁর পুত্রকে লিখেছেন, আল্লাহ যে আমাদিগের শাসক বানাইয়াছেন তাহার একমাত্র উদ্দেশ্য প্রজাদিগের মঙ্গলসাধন করা, কাজেই সেদিকে সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখিবে। তাহলেও সুশাসন মানেই তো আর সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের মঙ্গল না। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে সুশাসন শোষণ প্রক্রিয়াকে লঘু করে না বরং ক্ষেত্র বিশেষে জোরালো করে। তাছাড়া শাহজাদা দারা সম্পর্কে ভিন্ন মতও পাওয়া যায়। সমুগড়ের যুদ্ধে পরাজয়ের পর দারা যখন পলায়নপর ছিলেন তখন কিছুদিনের জন্য তাঁর সঙ্গি ছিলেন বিখ্যাত ফরাসি পর্যটক ডাক্তার বার্ণিয়ের। তিনি লিখছেন, সাধারণভাবে দারা সম্পর্কে যা বলা তিনি তেমন না। দারা হামবাগ ধরনের। তাঁর হিন্দু ধর্ম প্রীতি এবং শিয়া মতের অনুসারী হওয়ার কারণ সেনাবাহিনীতে তাদের সংখ্যাধিক্য। সেনাবাহিনীতে নিজের গ্রহণযোগ্যতাকে বৃদ্ধি করাই ছিল তাঁর আসল লক্ষ। আওরঙ্গজেবের শাসনের শেষ সময়ে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বিদ্রোহ আর বিশৃঙ্খলা যত বৃদ্ধি পাচ্ছিলো নিজেদের সংহতিকে জোরদার করার জন্য ধর্মের প্রশ্নে তিনি তত গোড়া হয়ে উঠছিলেন। কাজেই দেখা যাচ্ছে ধর্ম বা জাত-পাতের ব্যবহার সবসময়ই ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত। কোনো সর্বজনীন প্রেম বা মারফতি ভাবাবেগ দিয়ে এই দ্বন্দ্ব বা বিরোধের মীমাংসা হবার নয়।

মৃত্যুকালীন সময়ে সুদিনের প্রত্যাশায় অভয়চান্দ আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছিলেন – দরকার অনেক সময়, অনেক রক্তপাত। নিশ্চয়ই, এই বাস্তবতার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু কোনো মারফতি ভাবনা বা সর্বজনীন প্রেম যে সেই সুদিনের নিয়ামক না সেটাও নিশ্চিত। প্রকৃতপক্ষে প্রত্যাশিত সুদিন আসবে শ্রেণী সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতিতে এক শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। সে দিন আমাদের প্রত্যাশিত শুধু না, সেই দিনের লক্ষে সমাজে এক ধরনের সক্রিয়তাও নানাভাবে বিরাজমান।

ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে ছায়াপথ বাংলা কথাসাহিত্যের অনন্য সম্পদ, সন্দেহ নেই।

পাভেল চৌধুরী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Must Read

গৈরিক ভারত

১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী ভারতে জরুরী অবস্থা জারি করেছিলেন স্রেফ গদি হারানোর ভয়ে। সংবিধান প্রদত্ত ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে শুরু করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সবই বিলুপ্ত...